পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে ঝরনা বা জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ছোট ছোট পানির প্রবাহ৷ এ সব স্থান থেকে পানি তুলতে অনেক সময় মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় আদিবাসীদের৷
বিজ্ঞাপন
চংলা ম্রো এবং তাঁর সম্প্রদায়ের আরো অনেক নারীকে একসময় জঙ্গলের মধ্যকার সরু পথ ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো পানি সংগ্রহের আশায়৷ সেকাজ মোটেই সহজ ছিল না৷ সেপথে শুধু গাছ আর বাঁশ নয়, থাকত বিষাক্ত সাপ, বুনো শুকরসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণী৷ ফলে যে কোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা নিয়ে পাড়ি দিতে হতো লম্বা পথ৷
কিন্তু একবছর আগে একটি পানি সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনা ‘সিস্টেম' তাদের এলাকায় বসানোর পর পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ বান্দরবনের দুর্গম সেই এলাকায় ২১টি পরিবারের বাস যারা এখন আর বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহের জন্য যায় না৷ ‘থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন'-কে অতীতের কথা মনে করে চংলা ম্রো বলেন, ‘‘শেষবার রাতের বেলা পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে দুই মেয়ে বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়েছিল৷ এখন আর আমাদের সাপের কামড় খাওয়ার বা হিংস্র প্রাণীর হামলার শিকার হওয়ার ভয় নেই, কেননা পানির প্ল্যান্ট থেকেই প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায়৷''
পানির অপচয় রোধের দশ উপায়
পানির আরেক নাম জীবন৷ অথচ এই পানি, বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ যা জীবনের জন্য এক হুমকি৷ এই হুমকি মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে আপনাকেও৷ চলুন জেনে নেই পানির অপচয় রোধের দশ উপায়৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
এক কাপ কফি তৈরিতে ১৪০ লিটার পানি!
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য বা পানীয় তালিকার কিছু পণ্য তৈরিতে অনেক পানি প্রয়োজন হয়৷ যেমন এক কাপ কফি বাগান থেকে আপনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হচ্ছে ১৪০ লিটার পানি৷ আর এক লিটার দুধের পেছনে ব্যয় ১,০০০ লিটার পানি৷ তাই এ সব পানীয়র অপচয় কমানোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Fotolia/dmitrimaruta
মাংস খাওয়া কমাতে পারেন
ওয়াটারফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এক কেজি মাংস উৎপাদনে সবমিলিয়ে খরচ হয় ১৫ হাজার লিটারের মতো পানি৷ এই হিসাবের মধ্যে পশুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সময় প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণও বিবেচনা করা হয়েছে৷ এবার ভেবে দেখুন, এক বেলা মাংস না খেয়ে কতটা পানি বাঁচানো সম্ভব?
ছবি: picture-alliance/dpa
পানির ট্যাপের দিকের নজর রাখুন
মুখ ধোয়া বা দাঁত ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ রাখুন৷ একান্ত যদি গরম পানি পেতে ট্যাপ একটু খুলে রাখতে চান, তাহলে সেই পানি ব্যবহার করতে পারেন ব্রাশ ধোয়ার কাজে৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
কাপড় বা থালাবাসন পরিষ্কারে সতর্ক হন
কাপড় ধোয়া বা থালাবাসন পরিষ্কারের মেশিন এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷ পুরোপুরি ভর্তি না হওয়া অবধি এ সব মেশিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: Fotolia/lightpoet
অপ্রয়োজনে ফ্লাশ নয়
অনেকেই যখন-তখন টয়লেট ফ্লাশ করে থাকেন৷ এতে প্রচুর পানি অপচয় হয়৷ তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে ফ্লাশ করা থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: by-studio - Fotolia.com
পুকুরে ময়লা ফেলা নয়
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ সুযোগ পেলেই পুকুর বা খালে ময়লা ফেলে৷ এতে করে পানি দূষিত হয়৷ আর দূষিত পানি পুনরায় পান উপযোগী করে তুলতে খরচ হয় প্রচুর অর্থ এবং বিদ্যুৎ৷ তাই পুকুরে বা খালে ময়লা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে বা মাটিতে গর্ত করে ময়লা ফেলুন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
পানির পাইপের দিকে নজর দিন
অনেক সময় পানির পাইপে থাকা বিভিন্ন জোড়া হালকা হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি বাইরে পরে যায়৷ একটু সতর্ক হলেই এভাবে পানির অপচয় রোধ করা যায়৷ এছাড়া ছাদের ট্যাংকি ভর্তি হয়ে যাতে পানি বাইরে পরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷ সময়মতো পানির পাম্প বন্ধ করে দিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোসলের সময় অপচয় নয়
বাথরুমে থাকা গতানুগতিক বা পুরনো পানির ঝরনাগুলো সরিয়ে ফেলুন৷ বর্তমানে বাজারে পানি সাশ্রয়কারী ঝরনা পাওয়া যায়৷ সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পানির অপচয় রোধ সম্ভব৷ আর গোসলের সময় প্রস্রাব করার অভ্যেস তৈরির মাধ্যমে দিনে অন্তত একবার ফ্লাশ করার পানি বাঁচানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
পানি কখনো ফেলে দেবেন না
পানি পান করার পর যদি গ্লাসের তলায় খানিকটা পানি থেকে যায়, তাহলে তা ফেলে দেবেন না৷ সেটুকু আপনার গাছের গোড়ায় ঢালতে পারেন কিংবা চায়ের কেটলিতে জমাতে পারেন৷
ছবি: mdxphoto - Fotolia.com
সম্ভব হলে বৃষ্টির পানি জমা করুন
বৃষ্টির পানি জমা করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার এমনকি পান করাও সম্ভব৷ বর্তমানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের বিভিন্ন সরঞ্জামও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে৷ মনে রাখবেন, আপনার সামান্য উদ্যোগ পানির অপচয় রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ তাই চেষ্টা করে দেখুন না!
ছবি: DW/Karin Jäger
10 ছবি1 | 10
বন উজাড় করাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্বে বিশুদ্ধ পানির সীমিত আধারের উপর চাপ বাড়ছে৷ ফলে পানি সংগ্রহের নতুন নতুন উপায় বের করতে হচ্ছে৷ আর এ সব উদ্ভাবন এখন বিশেষ গুরুত্বও পাচ্ছে৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অংশের বন কেটে উজাড় করে ফেলায় সেখানকার মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ ফলে সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন গোষ্ঠীর পানি সংকট বাড়ছে৷ এই সমস্যা সমাধানে ‘অরণ্যক ফাউন্ডেশন' বাংলাদেশ ও মার্কিন সরকারের সহায়তায় সেখানে পানি সংগ্রহের বিশেষ পদ্ধতি স্থাপন করছে৷ এই ব্যবস্থায় পাহাড়ের কাছে মানুষের তৈরি পানির আধার তৈরি করা হয় যেখানে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি জমা হয়৷ এরপর তা পাইপের মাধ্যমে পানি পরিষ্কার করার ট্যাংকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আর সেখান থেকে পানি নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ তা পান করতে পারেন৷
এই ব্যবস্থায় মাটির তলা থেকে পানি তুলতে হয় না কিংবা পানি পেতে দামি কোনো পাম্পও দরকার হয় না৷ তবে প্রয়োজন হয় গাছপালায় পূর্ণ বন৷ ম্রোরা তাদের গ্রামের আশেপাশে তাই বেশি করে গাছ লাগাচ্ছে৷ বিশেষ করে সেসব জায়গায় যেখান থেকে আগে গাছে কেটে উজাড় করা হয়েছিল৷ এভাবে পানির সংকটও মিটছে, বনায়নও সম্ভব হচ্ছে৷
জলপরি নয়, এরা হলো ‘জলপত্নী’
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের বেশ কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে পুরুষরা শুধুমাত্র পানি এনে দেওয়ার জন্য বহুবিবাহ করেন! দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীর কাজ বাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণ পানির ব্যবস্থা করা৷ এরাই হলো ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
একজন পুরুষের তিনজন স্ত্রী
৬৬ বছর বয়সি সাখারাম ভাগতের এখন মোট তিনজন স্ত্রী৷ ওঁদের একজনের নাম সাখরি, পরের জন টুকি এবং তৃতীয় বউ ভাগি৷ ‘‘আমার প্রথম স্ত্রীকে সন্তানদের দেখাশোনা করতে হয়, তাই পানি আনার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করি৷ কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী যখন অসুস্থ হয়ে যায়, তখন পানি আনতে ভীষণ সমস্যা হতো৷ তাই তৃতীয়বার বিয়ে করি আমি’’, বলেন শাখারাম৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
‘ওয়াটার ওয়াইফ’-এর সম্মান
ছবিতে ভাগত তাঁর দুই স্ত্রী ভাগি এবং সাখরিকে নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছেন৷ এর জন্য তাঁদের গ্রাম ছাড়িয়ে অনেকটা পথ যেতে হয়৷ সংসারের প্রয়োজনে যাঁরা এতদূর থেকে পানি বয়ে আনেন, তাঁদের, অর্থাৎ এই ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’-দের গ্রামের মানুষরা কিন্তু খুবই সম্মানের চোখে দেখেন৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ
ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম ফেডারেল রাজ্য ‘মহারাষ্ট্রের’ এমনই একটি গ্রামর চিত্র এটি৷ কুয়ার সামনে স্থানীয় এক ‘জলপত্নী’ পানির পাত্র আর কলসিগুলোতো একে একে পানি ঢালছেন৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ভারতের প্রায় ১৯ হাজার গ্রামে খাবার পানি ছিল না৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
বাঁচার জন্য পানি সঞ্চয়
মহারাষ্ট্রে খরা নতুন কিছু নয়৷ শেষবারের খরার সময় সাখারাম ভাগতের পরিবার জলকষ্টে ভীষণভাবে ভুগেছে৷ তাই আর জলের কষ্ট নয়! পিতলের কলসিগুলোতে আজকাল সব সময়েই যথেষ্ট পরিমাণে পানি ভরে রাখছে ওরা, যাতে আর ভোগান্তি না হয়৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ
ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যন্ত এ সমস্ত গ্রামে ‘ওয়াটার ওয়াইফ’-এর রীতি বেড়ে চলেছে৷ তবে বেশিরভাগ সময়ই যেসব পুরুষ শুধু পানি আনার জন্য বিয়ে করেন, তাঁরা ‘জলপত্নী’-দের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো এক বিছানায় ঘুমান না৷ ঠিক সেরকমই একটি পরিবারের কর্তা নামদেব৷ তাঁর দুই স্ত্রী শিবারতি (বামে) এবং বাগাবাই৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
মাথায় পানি, কোলে নাতি
নামদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী শিবারতি অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথায় পানি বহন করে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে৷ কোলে নাতিটিকেও সঙ্গে নিতে হয়েছে তাঁর৷ ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’-দের জীবন এরকমই৷ তাঁরা এক হয় বিধবা অথবা একক মা৷ আগের পক্ষের সন্তান বা নাতি-নাতনিকে বড় করে তোলার জন্য অনেকক্ষেত্রে একাই অভিভাবকের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় তাঁদের৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
সাদা-কালো স্মৃতি চিহ্ন
নামদেবের প্রথম স্ত্রী বাগাবাই৷ তাঁর ঘরের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের পুরনো আমলের সাদা-কালো একটি ছবি৷ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্ত্রীর মর্যাদা যে প্রথম স্ত্রীর সমান নয়, দেয়ালের ঠিক মাঝখানে টাঙানো ছবিটি সেটাই বলে দিচ্ছে৷ তারপরও স্বামীকে একেবারে নিজের বলার উপায় আছে কি?