মানবসৃষ্ট বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই শুধু বিশ্বে এই পানি সংকট তৈরি হয়নি৷ বরং তার অনেক আগে থেকেই এই সংকট শুরু হয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক৷ এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপদ৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি বিশ্বের পানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি, যেখান উঠে এসেছে আফ্রিকা ও বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্র৷
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে পানি সংকট এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ বলছে, খুব সহসাই ‘ডে জিরো' বা যে দিন থেকে শুধু জরুরি প্রয়োজনে পানি সরবরাহ সম্ভব, সে দিনটি এসে যেতে পারে৷ আগামী মে মাস থেকেই বাসাবাড়ির ট্যাপে পানি হয়তো আর থাকবে না৷ বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হারে কমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর৷
বলা হচ্ছে, এসব ঘটনা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেবার জন্য ঘটেনি৷ এসব কারণ হয়তো পরে যোগ হয়েছে৷ কিন্তু এগুলো ঘটছে অনেক আগে থেকেই৷
একটু পানির জন্য
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে প্রত্যন্ত ১৩টি গ্রামের মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে অভিনব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ জার্মানির এক ফাউন্ডেশন এতে সহায়তা করছে৷
ছবি: M. Gundlach
প্রত্যন্ত এলাকা
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে অবস্থিত ১৩টি গ্রামে প্রায় ৪০০ মানুষের বাস৷ গ্রামগুলো এতই প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত যে, সেখানকার বাসিন্দাদের পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয়৷ প্রতিদিন এই কাজে গড়ে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়৷ সাধারণত নারীরাই এই কাজটি করে থাকেন৷ তবে একটি প্রকল্প তাঁদের কষ্ট লাঘবের স্বপ্ন দেখাচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
সমাধান কুয়াশা
এলাকাটি বছরের প্রায় ছ’মাস ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে৷ সেই কুয়াশাকে কাজে লাগিয়েই গ্রামবাসীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
কুয়াশা ধরতে জাল
পাহাড়ের উঁচুতে স্থাপিত বিশেষ জালে কুয়াশা আটকে পানি হয়ে ঝরবে৷ পানি ধরার জন্য থাকবে বড় বড় পাত্র৷ এরপর পাইপের মাধ্যমে তা পাহাড়ের নীচে অবস্থিত গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হবে৷ ঘন কুয়াশার সময় এক বর্গমিটার জাল থেকে দিনে প্রায় ২২ লিটার পানি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা৷ ভিডিও দেখতে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: M. Gundlach
জার্মান সহায়তা
যে প্রযুক্তিতে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে তার নাম ‘ক্লাউডফিশার’৷ জার্মানির ভাসাস্টিফটুং ফাউন্ডেশনের প্রকৌশলী পেটার ট্রাউটভাইন এটি উদ্ভাবন করেছেন৷ মরক্কোর বেসরকারি সংস্থা ‘দার সি হামদ’ ঐ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইতিমধ্যে প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কাজ শেষ করেছে৷ ফলে কিছু গ্রামের বাসিন্দারা এখনই তাদের ঘরে পানি পাচ্ছেন৷ কয়েকদিনের মধ্যে সবার জন্য পানির ব্যবস্থা করতে আরও জাল স্থাপনের কাজ শুরু হবে৷
ছবি: M. Gundlach
শিক্ষিত হচ্ছেন নারী
যে গ্রামগুলোতে ইতিমধ্যে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার নারীদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় বেঁচে যাওয়ায় এখন তাঁরা লেখাপড়া শেখা থেকে শুরু করে অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারছেন৷ প্রকল্পের আওতায় তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে৷
ছবি: Ane Nordentoft/Transterra Media
কাজের স্বীকৃতি
প্রকল্পটিকে সম্প্রতি জাতিসংঘের ক্লাইমেট চেঞ্জ পুরস্কার দেয়া হয়েছে৷ কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প বলে ধারণা করা হয়৷ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসির মুখপাত্র নিক নাটাল বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এ ধরনের অভিনব পরিকল্পনা সত্যিই এক দারুণ ব্যাপার৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
অনেক নদী এখন আর সমুদ্রে পৌঁছায় না৷ সেগুলোর দিক পরিবর্তিত হয়েছে, বাঁধ দেয়া হয়েছে এবং অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে৷
বলা হচ্ছে, যুগে যুগে বিশ্বে পানি সংকট বাড়ছে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হারে৷ এর মধ্যে পানি সংকটে সবচেয়ে বেশি এখন আফ্রিকার দেশগুলো৷ সেখানে খরা বাড়ছে৷
২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমনের উপরে স্থান দেয়া হচ্ছে৷ কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস গ্রাহাম কোগলি বলেন, ‘‘ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, অর্থাৎ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস, খুবই অনিয়ন্ত্রিত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হারে মাটির নিচের পানি তুলে ফেলা হচ্ছে৷''
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এই বেসিনের ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রায় অর্ধেক আবার ব্যবহারের অযোগ্য৷ কারণ, এতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি৷ তাই এগুলো পান করা বা কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী৷
ভূ-গর্ভস্থ পানি অন্তত বিশ্বের ৫০ ভাগ পান করা ও ৪০ ভাগ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়৷কিন্তু সেই পানি প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিচে একই হারে সেসব ভূগর্ভস্থ অ্যাকুইফায়ারে যুক্ত হয় না, যেমনটা বৃষ্টিতে মাটির উপরিভাগের জলাশয়ে ভরাট হয়৷
তাই ভূ-গর্ভস্থ পানিকে আর নবায়নযোগ্য বলা যায় না৷
‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ওয়াটার' বইয়ের লেখক পিটার গ্লাইক এএফপিকে বলেন, ‘‘মানুষ যেভাবে সময়ের আগেই এসব পানি ব্যবহার করে ফেলছে, তাতে এই পানি এখন অনবায়নযোগ্য হয়ে গেছে৷''
বছর জুড়ে বিশ্বের অন্তত ৫০ কোটি মানুষ প্রচণ্ড পানি সংকটে ভোগে বলে জানান বিশ্লেষকরা৷ গবেষণা বলছে, এর মধ্যে তিন জনের এক জনই ভারতে৷ এছাড়া পাকিস্তান, মিশর, মেক্সিকো, সৌদি আরব ও ইয়েমেনও এই সংকটপূর্ণ দেশের তালিকায় আছে৷
ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হোয়েকস্ট্রা বলেন, ‘‘এরপর এসব কারণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা৷''
জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ ভাগ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে৷
এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ৪০ ভাগ পানি সংকট দেখা দেবে৷
তারওপর এ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পানির চাহিদা বাড়বে ৫৫ ভাগ৷ তাই একটি সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ঢাকায় কার্ড ছোঁয়ালেই পানি
ঢাকায় রয়েছে পানির সংকট, যা তীব্র হয় শীতে৷ বিশুদ্ধ পানির সংকট আরো বেশি৷ এই সমস্যার সমাধানে পানির জন্য বুথ তৈরি করে প্রি-পেইড কার্ডে কেনার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
ঢাকার পানি সংকট
ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস৷ এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই এই শহরে৷ কিছু এলাকায় মাঝে মাঝেই পানির জন্য মানুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
বড় সংকট বিশুদ্ধ পানির
অনেকেই আবার পানি পেলেও বিশুদ্ধ পানি পান না৷ এমনকি ওয়াসার পানিও অনেক সময় দুর্গদ্ধ ছড়ায়৷
ছবি: Lalage Snow/AFP/Getty Images
শোধন অনুপযোগী পানি
ওয়াসা যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে, সেখানেও সমস্যা রয়েছে৷ অনেক সময় তা শোধনেরও অযোগ্য৷ পুরান ঢাকার কিছু এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয় চাঁদনীঘাট শোধনাগার থেকে৷ এই শোধনাগারের পানি আসে বুড়িগঙ্গা থেকে৷ এই নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, প্রায়ই তা শোধনেরও অযোগ্য হয়ে ওঠে৷ সেই পানিই সরবরাহ করা হলে বিপাকে পড়ে মানুষ৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
দূষিত পানিতেই চলে দিন
নিরূপায় ঢাকার অধিবাসীদের অনেকে তাই দূষিত পানি দিয়েই প্রাত্যহিক কাজ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Abdullah
মিটারে পানি
নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াসা নানা সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে৷ সম্প্রতি প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যেম এটিএম বুথ থেকে পান বিতরণের একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করেছে তারা৷
ছবি: bdnews24.com
নামমাত্র মূল্য
নতুন এই ব্যবস্থায় দুই শত টাকা দিয়ে একটি কার্ড সংগ্রহ করতে হয়৷ এরপর সেই কার্ড রিচার্জ করে পানি সংগ্রহ করতে হয়৷
ছবি: bdnews24.com
কার্ড ছোঁয়ালেই পানি
এই ব্যবস্থায় কার্ড পাঞ্চ করার একটি জায়গা রাখা হয়েছে৷ সেখানে কার্ড ছোঁয়ালে স্ক্রিনে ভেসে উঠে ব্যালেন্স৷ পর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকলে সুইচ টিপলেই পাশের কল দিয়ে বেরিয়ে আসে পানি৷
ছবি: bdnews24.com
শীঘ্রই ১০০ বুথ
আপাতত একটি বুথ থাকলেও শীঘ্রই বুথের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিশুদ্ধ পানি
ওয়াসার লাইনের পানিও সাধারণত বিশুদ্ধ করে খেতে হয়৷ পাম্পের পানির সুবিধা হচ্ছে, এটা ফুটানো বা অন্য কোনোভাবে বিশুদ্ধ না করেই খাওয়া যায়৷ এর ফলে পাম্প থেকে পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা একটা শৃঙ্খলার মধ্যেও আসবে বলেই আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: bdnews24.com
প্রি-পেইড কার্ড অন্য জায়গায়
বাংলাদেশে আরো বেশ কিছু সেবায় প্রি-পেইড মিটার চালু করা হচ্ছে৷ গ্যাস-বিদ্যুতের বিল-খেলাপি ঠেকাতে এবং গ্যাসের অপচয় রোধ করতে এই দুই খাতে এ ধরণের মিটার দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ গত বই মেলায় বই কেনার জন্যও এক ধরণের প্রি-পেইড কার্ড বাজারে এসেছিল৷