নাটোরের গাজীপুরের বাসিন্দা গোলাম রব্বানী টাক মাথা থেকে ধোঁয়া বের হয়৷ তবে সব সময় নয় কাঁচা সুপারি ও মসলা দিয়ে পান খেলে বের হয় ধোঁয়া৷ সেই সময়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর গণমাধ্যমেও এসেছে এ খবর৷
বিজ্ঞাপন
শীতের সময় কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার পর মাথায় ধোঁয়া ওঠা ‘অস্বাভাবিক' কিছু নয় বলে মনে করেন নাটোরের সিভিল সার্জন রোজী আরা খাতুন৷ ডা. রোজী আরা খাতুন ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা গোলাম রব্বানীকে ডেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন৷ দেখা গেছে তার প্রেশার ও কোলেস্টেরল হাই৷ তবে কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে ধোঁয়া বের হচ্ছে না৷
শীতকালে কেউ যদি হাঁ কর করে তাহলেই ধোঁয়া বের হয় জানিয়ে ডা. রোজী বলেন, "উনার মাথায় ধোঁয়াটা শুধু শীতকালেই বের হয়, অন্য সময় বের হয় না৷ কাঁচা সুপারি খাওয়ায় উনার মেটাবলিজমটা হয়তো একটু বেশি হচ্ছে, যে কারণে একটু ধোঁয়া বের হতেই পারে৷ এটা স্বাভাবিক ঘটনা, অস্বাভাবিক কিছু না৷”
ধোঁয়া ওঠার ব্যাপারটা ব্যক্তি বিশেষে কমবেশ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, "গোলাম রব্বানীর মাথায় ধোঁয়া উঠার চিত্রটা দৃশ্যমান, অন্যদেরটা দেখা যাচ্ছে না৷”
সোমবার রাতে বাগাতিপাড়ার যোগীপুর বাজারে একটি পানের দোকানে গিয়ে অনেক লোকের ভিড় চোখে পড়ে৷ ভিড় ঠেলে এগোতেই দোকানের বেঞ্চে ঘর্মাক্ত অবস্থায় টুপি পরে বসে পান চিবাচ্ছিলেন গোলাম রব্বানী৷
বাজারে উপস্থিত যোগীপাড়ার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রব্বানি যখন যোগীপাড়া বাজারে এসে কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খান, তখন প্রচণ্ড ঘামেন; আর মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হয়৷
কেউ কেউ বলেন, ওইদিন শীত একটু কম থাকায় ধোঁয়া কম উঠছিল৷ আগের দিন শীত বেশি ছিল বলে বেশি ধোঁয়া বের হয়েছিল৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পান দোকানদার ও এলাকাবাসী স্মার্ট ফোন থেকে রোববারের (২৯ জানুয়ারি) কয়েকটি ভিডিও বের করে দেখান, সেখানে দেখা যায় অনেক মানুষের সামনে কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার পর রব্বানির মাথা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে৷
যোগীপাড়া বাজারের পান দোকানদার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, "রব্বানী সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই৷ আমার পাশের গ্রামেই বাড়ি৷ আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে উনি প্রথম আমার দোকানে পান খাওয়ার পর দেখি উনার মাথা দিয়ে ব্যাপক ধোঁয়া বের হচ্ছে৷
"এ বিষয়ে তার ব্যবসায়িক পার্টনারদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ভয়ের কারণ নেই, শীতের দিনে পান খেলে এই অবস্থা হয়৷ শীত কম থাকলে ‘হালকা ধোঁয়া' বের হয়৷”
তার দোকানের বয়স ১৪ থেক ১৫ বছর জানিয়ে আশরাফুল বলেন, "উনি আমার নিয়মিত কাস্টমার৷ শীত আসলে আমি একই অবস্থা দেখি৷ উনি ময়মসলা দিয়ে পান খান৷ ধনিয়া, যাওন, কালোজিরা ছাড়া উনি জর্দা খান না৷ শীতের দিনে উনার বেশি পান কিনে খেতে হয় না৷ এলাকার লোকজন মাথা দিয়ে ধোঁয়া ওঠা দেখতে ৫-৬টা পান উনাকে কিনে খাওয়ান৷”
এ ব্যাপারে গোলাম বব্বানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শীত থাকলে একটা পান খাওয়ার পরেই মাথায় ধোঁয়া ওঠে৷ তিনি ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে পান খান৷ চার থেকে পাঁচ বছর ধরে তার মাথায় ধোঁয়া ওঠে৷ সাদা পান বা মশলা পান যেটাই খান ধোঁয়া ওঠে, জর্দা লাগে না৷
"আজকে শীত নাই তাই বের হয়নি, শীত থাকলে ধোঁয়া বের হয়৷ গরমে শরীর শুধু ঘামে কিন্তু ধোঁয়া ওঠে না৷ কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার জন্য আমার শারীরিক কোনো সমস্যা হয় না৷ মাথাটা একটু গরম হয়, তাই মাথার চুলগুলো সব উঠে গেছে৷”
পান স্বাদ লাগে, ভালো লাগে বলে খান; ধোঁয়া তোলার জন্য না, বলেন তিনি৷ প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ২০ টা পান লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শীতের দিনে অনেকেই ধোঁয়া দেখার জন্য ফ্রি পান খাওয়ান, তাছাড়া তিনি টাকা দিয়েও পান কিনে খান৷ প্রতিদিন একরকম ধোঁয়া বের হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, "একদিন একটু বেশি হয়, একদিন একটু কম হয়৷ কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খেলে শরীরটা হিট হয়৷ আমার বাড়িতে দেড়শ থেকেই দুইশ সুপারি গাছ আছে৷ আমি সারাবছর কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাই৷ এখন পর্যন্ত আমার শারীরিক সমস্যা হয়নি, তাই কোনো ডাক্তারের কাছে যাইনি৷”
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
বাঙালির পান, জামালপুরের পান
বাঙালির জীবনের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ পান। উৎসব-পার্বণ তো বটেই, অনেক বাঙালির দৈনন্দিন আহার শেষেও মুখে থাকে এক খিলি পান৷ ছবিঘরে জামালপুরের বরজকে ঘিরে উঠে এসেছে বাঙালির পান খেয়ে ঠোঁট লাল করার গল্প...
ছবি: Waliul Biswas
বাংলাদেশের পান ও জামালপুর
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পানের চাষ হয়। সারাদেশে পানের আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১৪,১৭৫ হেক্টর। মোট বার্ষিক উৎপাদন ৭২ হাজার ৫০০ টন। একর প্রতি গড় ফলন ২.২৭ টন। জামালপুর জেলায় ২০০ থেকে ২২০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়ে থাকে। নান্দিনা, রাণাগাছা, নারুন্দি, ঘোড়াধাপসহ বিভিন্ন স্থানে পানের বরজ আছে। স্থানীয়দের মতে, জামালপুরে পানের বরজ আছে ১০ হাজারের ওপরে।
ছবি: Waliul Bishwas
গ্রামীণ ‘ডেজার্ট’
খাবারের শেষে অনেক জায়গায় মিষ্টি পান খাওয়ার প্রচলন আছে। বিশেষত বিয়ে বাড়িতে এ আয়োজনটি রাখা হয়। এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও। সুপারি, চুন, জর্দা, খয়েরসহ বেশ কয়েকটি উপাদান যোগ করে পান পরিবেশন করা হয়।
ছবি: Waliul Bishwas
পানের বরজ
বাঁশ ও পাট শলা, খুঁটি, বাঁশের কঞ্চি ও ছন ব্যবহার করে তৈরি করা হয় জমির চারদিকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে চালা দাঁড় করানো হয়, সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় বেড়া। তবে চালের ফাঁক দিয়ে অতিরিক্ত রোদ এলে পোকার সংক্রমণ হয়। অন্যদিকে জমি তৈরিতে বরজের ১ ফিট দূরত্ব দিয়ে ড্রেন করে দিতে হয়।পানের লতা রোপণ করার ৬-৭ মাস পর পাতা সংগ্রহ শুরু হয়। একবার লতা লাগালে ২০ বছরের বেশি সময় চলতে থাকে।
ছবি: Waliul Bishwas
চাষের খরচ ও ব্যবসার দিক
সপ্তাহে দুই-তিনবার তোলা হয় পান। ১০ শতাংশ জায়গা থেকে প্রতিবার ৭০-৮০ বিড়া পান কাটা হয়। জেলাভেদে বিড়াতে পানের পরিমাণ হেরফের হয়। জামালপুরে এক বিড়ায় ৮০টি পান রাখা হয়। চাষিরা প্রতি বিড়া পাইকারি বিক্রি করেন ৬০-৭০ টাকায়। অর্থাৎ, প্রতি সপ্তাহে ৯-১০ হাজার টাকা পান চাষি। তবে খরচও আছে। ১০ শতাংশ জমিতে বছরে চার বার ৩০ কেজির মতো সার দিতে হয়। এছাড়া শ্রমিক দিয়ে আগাছা দূর করা ও বেড়ার কাজ করাতে হয়।
ছবি: Waliul Bishwas
পান তোলার সময়
রোদের মধ্যে পান পাতা তুললে সতেজ ভাব নষ্ট হয়। এ কারণে সাধারণত খুব ভোরে পান তোলা হয়। সকালের রোদ ওঠার আগেই তা আড়তে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারের কথা বিবেচনা করে বিকালেও তোলা হয় পান পাতা। জামালপুরের বেশিরভাগ বরজের পান কাটা হয় হাটের দিন ভোরে। জেলার নান্দিনা-নারুন্দি এলাকায় প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার ভোরে পান তোলা হয়।
ছবি: Waliul Bishwas
পান তোলার নিয়ম
কার্তিক, ফাল্গুন ও আষাঢ় মাসে পান বেশি কাটা হয়। তবে কার্তিক মাসের পানকে ভোক্তারা সেরা এবং আষাঢ় পানকে সবচেয়ে খারাপ বলে মনে করেন। তবে শীতের সময় পানের কদর বেশি। কারণ, তখন দামটা বেশি পায় কৃষকরা। পান তোলার একটা নিয়মও রয়েছে। লতায় কমপক্ষে ষোলটি পাতা রেখে দেওয়ার নিয়ম। বাকি পাতাগুলো তোলা হয়। সঠিক পরিচর্যায় একটি বরজ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনবার পাতা সংগ্রহ করা যায়।
ছবি: Waliul Bishwas
পারিবারিক যত্নে বেড়ে ওঠে পানের বরজ
নান্দিনা, রাণাগাছা, নারুন্দি, ঘোড়াধাপসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অনেক ছোট ছোট বরজ। পান চাষিদের পরিবারের সদস্যরাই পান তোলেন। এমনকি ছোট বাচ্চারাও নিয়মিত যায় বাগানে। তাদের কাছে এটা উৎসবের মতো। বাড়ির মেয়েরা পান কাটার পর তা বাছাইয়ের কাজ করেন। আর পরিবারের কর্তা বা বড় ছেলেদের দায়িত্ব থাকে তা আড়তে নিয়ে বিক্রি করার। তাই পানের বরজের প্রতিটি পদক্ষেপে যুক্ত থাকেন পরিবারের প্রতিটি সদস্য।
ছবি: Waliul Bishwas
জামালপুরের পানের বাজার
স্থানীয় বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখ যায়, জামালপুরের বাজারে অন্য জেলার পানেরও বেশ কদর। বিশেষ করে রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গার পান বেশ চলে। বরিশালের পানও পাওয়া যায় জামালপুরে। তবে স্থানীয় পান হওয়ায় জামালপুরের পানের দাম তুলনামূলকভাবে কম। আবার আকৃতিতে রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গার পান বড় হওয়ায় উৎসব-পার্বণে স্থানীয়রা এই জেলাগুলোর পান কেনেন। অন্যদিকে দাম কম হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের প্রথম পছন্দ জামালপুরের পান।
ছবি: Waliul Bishwas
সরকারি উদ্যোগের আশা
পানের কারণে অনেক পরিবার খুব ভালো জীবন যাপন করছে- এ কথা স্বীকারও করেন পান চাষিরা। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্বান্তও হতে হয়। এছাড়া বরজে হঠাৎ পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়। এসব বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চান কৃষকরা। তারা আশা করেন, দুর্যোগের সময় সরকার পাশে দাঁড়াবে এবং চাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেবে। তারা চান পান নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হোক। এতে সবাই লাভবান হবে।
ছবি: Waliul Bishwas
গানে পান
বাঙালি জীবনে এমন চিরল আবেগে জড়িয়ে আছে পান। শুধু প্রত্যাহিক জীবনেই নয়, আমাদের শিল্প সাহিত্যেও গুরুত্ব পেয়েছে পান৷ ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’, ‘পান দিলে পান খাইও না’- গানগুলো এখনো অনেক বাঙালির মুখে মুখে ফেরে৷ ওপরের ছবিতে ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’ গানের শিল্পী রুনা লায়লা৷
ছবি: bdnews24.com
ঢাকার বাহারি পান
ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় পসরা মেলে বসে পানের দোকান। মোহাম্মদপুরের ক্যাম্প বাজার এলাকায় রয়েছে ৬-৭টি পানের দোকান। সেখানে পানের নামগুলোও বেশ বাহারি। আগুন পান, সাঁচি পান, মিষ্টি পান, ম্যাজিক পান, ঠোঁট লাল পান, হরিণনাভি মৃগনাভি কুস্তরী- কত ধরনের নাম যে আছে পানের! পুরাণ ঢাকার নাজিরাবাজার এলাকাতে বেশ কয়েকটি বাহারি পানের দেখা মেলে। তবে সেগুলো মশলার কারণে বিখ্যাত।
ছবি: Waliul Biswas
এক টাকার পান ঢাকায় হাজার টাকা
মোহাম্মদপুর ক্যাম্প বাজারে হরিণনাভি মৃগনাভি কুস্তরী পান বিক্রি হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায়। আছে ১২০০ টাকার বিশেষ পানও। পুরান ঢাকার দোকানগুলোর সবচেয়ে দামি পানের নাম ‘লাভ ফর এভার’। দাম ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে এই বাহারি দোকানগুলোর মধ্যে বেশি চলে ‘আগুন পান’, যার দাম দোকান ভেদে ৪০ থেকে ১০০ টাকা। ঢাকায় ‘পান-সুপারি’ নামে অভিজাত একটি দোকান গত দুই দশক ধরে চলছে। সেখানে পান-সুপারি স্পেশালের দাম ৩০০ টাকা।