পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও বিতর্ক
৬ জানুয়ারি ২০১২ফুকুশিমার ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর পরিণতি জানার পর থেকে জার্মানিতে জোরদার হয়ে ওঠে পরমাণু স্থাপনা বিরোধী আন্দোলন৷ এক পর্যায়ে জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় ২০২২ সালের মধ্যে তাদের সকল পারমাণবিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার৷ তাই সেই লক্ষ্য পূরণে বিকল্প নানা পন্থা নিয়ে এগুচ্ছে জার্মানি৷ কিন্তু ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্স এখনও পারমাণবিক কারখানাগুলোর ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি৷ ফ্রান্সের রয়েছে ৫৮টি পারমাণবিক চুল্লি৷ আর এগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে তাদের মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ পূরণ হয়৷ তাই পারমাণবিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এই দেশটিতেও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা-পর্যালোচনা৷
এবার ফ্রান্সের পরমাণু বিষয়ক নজরদারি সংস্থা পরমাণু নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ - এএসএন পেশ করলো একগাদা সুপারিশ৷ মূলত যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল থেকে যেন দেশটির সবগুলো পারমাণবিক স্থাপনাকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং দু্র্যোগের কবলে পড়লে যেন দ্রুত প্রতিকার ও নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয় - সেব্যাপারেই জোর দেওয়া হয়েছে এএসএন-এর সুপারিশমালায়৷ এতে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ একটি ‘ব়্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স' গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ যাতে করে সেই বিশেষ বাহিনী যে কোন দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব পারমাণবিক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে৷
ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া ফিঅঁ'র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এসব সুপারিশমালা৷ তবে এএসএন-এর পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এখনই তাদের কোন পরমাণু কারখানা বন্ধ করা জরুরি নয়৷ তারা বরং আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সবগুলো পরমাণু স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতোটা উন্নত করার দাবি জানিয়েছে যাতে বন্যা কিংবা ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও বিকল্প পন্থায় পরমাণু চুল্লিগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভব হয়৷ অবশ্য এএসএন-এর এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে কয়েক কোটি ইউরো ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির সভাপতি আঁদ্রে ক্লোদ লাকস্ত্৷ তাই তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর ফলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন হবে৷
যাহোক, প্রধানমন্ত্রী ফিঅঁ'র দপ্তর থেকে অবশ্য আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, এএসএন-এর সুপারিশমালার সবকিছুই সঠিক সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হবে৷ তারপরেও এএসএন-এর এসব সুপারিশমালাকে ‘প্রেডিক্টেবল ট্রিক' বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছে ফ্রান্সের পরমাণু বিরোধী গোষ্ঠী ‘নিউক্লিয়ার অবজারভেটরি'৷ এছাড়া দেশটির সবুজ দলের সাথে সুর মিলিয়ে পরমাণু বিরোধী প্রস্তাবনা পেশ করেছে বিরোধী সমাজবাদী দল৷ তারা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪টি পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ করে পরমাণু শক্তির উপর তাদের নির্ভরশীলতা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে৷
জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশে যখন পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে এমন উদ্বেগ, তখন বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে পরমাণু বিদ্যুৎ কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক এবং উৎকণ্ঠা৷ বাংলাদেশের ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'এর যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলে'কে বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ আমাদের দেশে প্রয়োজন সেটা ঠিক কিন্তু আমরা বলতে চাই যে, ক্ষুধা মেটানোর জন্য আমরা বিষ খেতে পারি না৷ তাছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব এমন প্রযুক্তি ও সামর্থ্য নেই যে, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কারখানা থেকে যে পরিমাণ পরমাণু বর্জ্য তৈরি হবে তা সঠিকভাবে পরিশোধন করতে পারবে৷ সেই বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নিয়ে যাবে কি না তা এখনও আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারিনি৷ আরেকটি সমীক্ষায় আমরা দেখেছি যে, ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে সেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩৭ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার দুইশ' টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, দুই হাজার দুইশ' বিশ টন হাইড্রোকার্বন, ৭২০ টন কার্বন মনো-অক্সাইড, ১৭০ পাউন্ড পারদ, ২২৫ পাউন্ড আর্সেনিক এবং ১১৪ পাউন্ড সিসা'সহ অন্যান্য বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হবে৷ তাছাড়া পরমাণু স্থাপনা থেকে বিপুল পরিমাণ ছাই এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বাতাস, ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ করবে৷ তাই এতো বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত শোধনাগার না থাকলে তা আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের জন্য একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক