‘পারিবারিক কলহ ও অর্থনৈতিক সংকটে কিশোর অপরাধ বাড়ে’
২০ অক্টোবর ২০২৩করোনা পরবর্তী সময়ে কিশোর অপরাধ অনেক বেড়েছে৷ দেশে বর্তমানে তিনটি শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে৷ এর একটা মেয়েদের জন্য এবং দুইটা ছেলেদের জন্য৷ এগুলোতে ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বন্দি আছে৷ সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে কি শিশু-কিশোররা সংশোধন হচ্ছে? শিশু-কিশোর অপরাধ বেড়েই বা যাচ্ছে কেন? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সমাজকল্যান প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরু৷
ডয়চে ভেলে : দেশে এখন কতগুলো শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র আছে? শিশু-কিশোররা যে সংখ্যায় অপরাধে জড়াচ্ছে তাতে এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো কি যথেষ্ট?
আশরাফ আলী খান খসরু : আমাদের এখন তিনটা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে৷ এগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না৷ আমি দুই দিন আগে যশোরে উন্নয়ন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম৷ সেখানে ধারণক্ষমতা ১২০ জনের, আছে প্রায় ৩০০ জন৷ বাকি দুইটার একটা নারী ও আরেকটা পুরুষদের জন্য৷ একটা টঙ্গিতে আরেকটা মিরপুরে৷ সেখানেও ধারণক্ষমতার চেয়ে সংখ্যা অনেক বেশি মানুষ৷ এগুলো আরও বড় করার পরিকল্পনা আমাদের আছে৷ ভবিষ্যতে আমরা আরও দুই একটা নির্মাণ করব৷ আগে জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, তারপর সেটা করতে হবে৷ শিশু অপরাধী তো বাড়ছে৷ ১৮ বছরের নিচে কেউ অপরাধী হলে আদালত তাদের আমাদের এখানে পাঠায়৷ এখানে আরেকটা বড় সমস্যা হল, ১৮ বছরের উপরেও অনেকে থেকে যায়৷ যেমন ধরেন, একটা কিশোর ১৭ বছর বয়সে অপরাধ করেছে৷ তার বিচার তো দু'এক বছরে শেষ হচ্ছে না৷ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে এখানেই থাকছে৷ তখন কিন্তু তার বয়স ১৮ বছরের অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে৷ এই কিশোরদের রাখাটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অসুবিধা৷
টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গত আগস্টে এক কিশোরের মৃত্যুর পর কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নের কথা আপনারা বলেছিলেন৷ সেটা কতদূর এগিয়েছে?
কেন্দ্রগুলো কিন্তু উন্নত৷ আপনারাও যদি সেখানে যান দেখবেন ভেতরের অবস্থাসহ সবকিছুই ভালো৷ এরা তো শিশু অপরাধী৷ ফলে অনেক সময় তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না৷ ফলে একটা কাজ করে ফেলে৷ এর কারণটাই হল ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত অবস্থান৷
আমরা নিয়মিত দেখছি, কিশোররা নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে৷ এমনকি গ্যাং কালচার তৈরি হয়েছে৷ কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার এই প্রবণতা কি আগের চেয়ে বেড়েছে?
আপনারাও তো নিয়মিত পত্রপত্রিকায় দেখছেন কিশোর গ্যাং তৈরি হয়েছে৷ এই প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে৷ এটার ব্যাপারে আমাদের প্রশাসনও সজাগ আছে৷ তারাও ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং অপরাধীদের ধরছে৷ এটা আস্তে আস্তে কমে যাবে৷ করোনার কারণে এটা আসলে বেড়েছে৷
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, পারিবারিক ও সমাজিক অস্থিরতার কারণেই কি কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে?
অবশ্যই৷ পারিবারিক কলহ বেড়েছে৷ একান্নবর্তী পরিবারগুলো এখন আর নেই৷ এই কারণে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে৷ অনেক সময় অর্থনৈতিক অবস্থা থেকেও হয় এগুলো৷ একটা শিশু যখন স্কুলে যায় তার মা-বাবা যদি ঠিকমতো খেয়াল না রাখে তখন শিশুটা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷
উন্নয়ন কেন্দ্র গিয়ে কি শিশু-কিশোররা আসলে সংশোধন হচ্ছে? নাকি তারা অপরাধীই থেকে যাচ্ছে?
কিছু তো সংশোধন হয়ই৷ যারা অনেকদিন থাকে তারা কিছুটা সংশোধন হয়৷ অনেক সময় তারাও বুঝতে পারে যে, তারা অন্যায় করেছে৷ সবকিছুরই তো ভালো-মন্দ আছে৷ সবাইকে যে আমরা ভালো করে ফেলতে পারি বিষয়টা এমনও না৷
উন্নয়ন কেন্দ্র গুলোতে শিশু-কিশোরদের শিক্ষামূলক-বিনোদনমূলক ব্যবস্থা কি আছে?
বিনোদনমূলক ব্যবস্থা তো আছে৷ খেলার মাঠ আছে৷ সেখানে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়৷ এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে৷ সেখানেও বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হয়৷
আগের মতো খেলার মাঠ বা পর্যাপ্ত খেলাধূলার ব্যবস্থা না থাকার কারণে কি কিশোররা বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে?
আমাদের তো আসলে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই৷ এটা যেমন দায়ী, তেমনি পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থাও দায়ী৷ করোনার পর এটা বেড়েছে৷
ইন্টারনেটের প্রসার, সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেট গেমিং কি কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ করছে?
এটা তো আপনি নিজেও বোঝেন৷ ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ দু'টোই আছে৷ ইন্টারনেটে জুয়া খেলায় যদি কেউ ঢুকে যায় তখন তাকে ফেরানোটা কঠিন হয়ে যায়৷ ইন্টারনেট তো মাদকের চেয়েও বেশি নেশা৷ এজন্য আমরা পরিবারের প্রধানকে সবসময় বলি, সন্তানকে যখন একটা ফোন কিনে দেবেন তখন তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে৷ এটা দিয়ে সে কী করছে সেটা খেয়াল রাখতে হবে৷
কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত আইনের সংস্কার কতদূর?
এটা প্রক্রিয়াধীন আছে৷ কাজ চলছে৷
কিশোর অপরাধ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর কি ধরনের পদক্ষেপ নিলে এটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?
আমার প্রথম কথা, পরিবার থেকে প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে৷ পরিবারকেই লক্ষ্য রাখতে হবে তার ছেলেটা কী করে, কোথায় যায়? তার ছেলের বন্ধু বান্ধব কারা? দ্বিতীয় হল স্কুল৷ স্কুলের দায়িত্ব হল কোন ছেলে যদি স্কুলে না আসে তাহলে তার পরিবারকে চিঠি দিয়ে জানানো৷ এই পদক্ষেপগুলো নিতে হবে৷ তাহলে এই সংশোধনগুলো হবে৷ আমাদের একটা প্রবণতা হয়ে গেছে, আমরা যখন রাস্তা দিয়ে যাই, কাউকে অপরাধ করতে দেখলেও কিছু বলি না বা প্রতিবাদ করি না৷ এতে ছেলেগুলো আশকারা পেয়ে যায়৷ আপনি কিছু না বলেন, ৯৯৯-এ ফোন করে তো জানাতে পারেন? তাও করে না৷ কিন্তু আজকে যেটা আপনি দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন, কাল দেখবেন আপনার সন্তানই এই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে৷ শুধু সরকার আর প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না৷ সবাই এগিয়ে না এলে একটা সমাজ তার কলুষতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না৷