শি জিনপিং-এর তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। তার আগে কমিউনিস্ট পার্টির এই প্রস্তাব নিল। একশ বছরের ইতিহাসে এই নিয়ে তৃতীয়বার প্রস্তাব নিল কমিউনিস্ট পার্টি। এর আগে ১৯৪৫ সালে মাও-এর জন্য নিয়েছিল। এরপর ডেং-এর সময় দ্বিতীয়বার প্রস্তাব নেয়া হয়। তৃতীয়বার নেয়া হলো শি-র জন্য। মাও ও ডেং-এর সমকক্ষ হলেন শি জিনপিং।
কী বলা হয়েছে প্রস্তাবে
প্রস্তাব রীতিমতো দীর্ঘ। সেখানে দলের ইতিহাস সম্পর্কে ঠিক মনোভাব নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংবাদসংস্থা জিনহুয়া জানিয়েছে, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চীনের সমাজ ও সব সংস্থার ঐক্যবদ্ধ হয়ে শি-র পাশে দাঁড়ানোর এটাই সময়। শি-র মতাদর্শ হলো চীনের আত্মা ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্তসার।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলে শি-র উপস্থিতির মূল্য অপরিসীম। দলের হৃদয়ে শি আছেন। জাতির নবজীবনের ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শি। পুরো দল, সেনাবাহিনী, দেশের মানুষ, সব জাতিগোষ্ঠীকে এক হয়ে শি-র পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে এবং তার মতাদর্শ রূপায়ণ করার কথা বলা হয়েছে। সেন্ট্রাল কমিটির মতে, শি সমাজবাদের নতুন যুগ শুরু করেছেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। ছবিঘরে দেখুন তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: Reuters/Jason Leeকমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা শি ঝংজুন ছিলেন তাঁর পিতা৷ পিতার কীর্তি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে শুরুর দিকে বাধা তৈরি করে৷ ১৯৬২-তে দল থেকে বহিষ্কৃত হন ঝংজুন৷ কয়েক বছর পর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিপীড়িত হন, এমনকি জেলেও যেতে হয় তাঁকে৷ সেই পিতার ছেলের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করে অবশেষে ১৯৭৪-এ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি৷ সেই থেকে শুরু শি জিনপিংয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media/Pictures From Historyরসায়ন প্রকৌশলের ছাত্র শি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে৷ কঠিন পরিশ্রম করেন৷ আট বছর পর দলের পক্ষে প্রথম বড় পদটি পান৷ ১৯৮২ সালে নির্বাচিত হন দলের হের্বেই রাজ্যের সম্পাদক৷ এরপর একে একে বেশ কয়েকটি প্রদেশের গভর্নর নির্বাচিত হন৷ এমনকি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য ও ব্যবসাকেন্দ্র সাংহাই রাজ্যদলের প্রধানের পদটিও ঝুলিতে পুরে নেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/CPAশি’র ক্যারিয়ারে ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন৷ যে দল তাঁর পিতাকে বহিষ্কার করেছে সেই কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি৷ এমন কি কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত করে, যার অর্থ হলো, অলিখিতভাবে তিনি হয়ে ওঠেন চীনের নেতা৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-এর দু’বারের মেয়াদ শেষ হবার পর চীনের জাতীয় কংগ্রেস তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে৷
ছবি: GOH CHAI HIN/AFP/Getty Imagesনির্বাচনের পর শি-এর রাজনৈতিক শ্লোগান হয় ‘চাইনিজ ড্রিম’৷ অনেকে একে আমেরিকান ড্রিমের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললেও আসলে এর অর্থ চীনের নবউত্থান৷ শি একে ‘চীনা জাতির মহাউত্থান’ হিসেবেই উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, চীনকে পৃথিবীতে এর ‘প্রাপ্য জায়গা’ নিশ্চিত করতে হবে৷ তাঁর মতে, সেই জায়গা করতে গিয়ে ‘শত্রুর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে’ যেতেও পিছপা হবে না চীন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong১৯৪৯ সালের চীনের গৃহযুদ্ধের পর শি’ই প্রথম কোনো চীনা নেতা যিনি তাইওয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট মা ইয়িং-জু’য়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি৷ তার মানে এই নয় যে তিনি ছাড় দিতে রাজি আছেন৷ ২০১৮ সালের মার্চে তিনি তাইওয়ানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি আলাদা হবার চিন্তা আসে মাথায়, তাহলে ‘ইতিহাসের শাস্তি’ জুটবে তাদের কপালে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/W. Maye-E২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শি কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতার স্বীকৃতি পান৷ এ স্বীকৃতি এর আগে কেবল আধুনিক চীনের স্থপতি, দলের সাবেক চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং আরেক সাবেক চেয়ারম্যান দেং জিয়াওপিং ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন পেয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/Feng Li২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের (যেটি মূলত সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে) নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়৷ এতে করে ৬ লাখ ৬০ হাজার শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photoএকনায়কতন্ত্রের খড়গ হতে দেশকে বাঁচাতে ১৯৮২ সালে জিয়াওপিং নিয়ম করেন যে, একজন দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না৷ ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ, চীনের সংসদ শি’কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে এবং ভোটের মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করে যে, একজন প্রেসিডেন্টের দু’বার নয়, বরং অনির্দিষ্টবারের জন্য নির্বাচিত হতে পারবেন৷ তাই শি-এর সামনে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার পথ খোলা৷
ছবি: Reuters/Jason Lee প্রস্তাবের গুরুত্ব
এই প্রস্তাবের ফলে শি-র গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল এবং তাকে কমিউনিস্ট পার্টির অন্য প্রধান নেতাদের সমপর্যায়ভুক্ত করা হলো। তিনি মাও ও ডেং-এর সমপর্যায়ভুক্ত হলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে শি-র ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হলো। তিনি তার ভিশন অনুয়ায়ী চলতে পারবেন। এই প্রস্তাবে মাও-র নাম সাতবার উল্লেখ করা হয়েছে। ডেং-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচবার, আর শি-র নাম ১৭ বার। মাও-এর কালচারাল রেভলিউশনের সময়কে আগের মতো পুঁজিবাদী বা চিরাচরিত পথে চলার চেষ্টা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে কালচারাল রেভলিউশনের সময় ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও পুনর্গঠনের সময়।
শি-র অবস্থান
ডেং চীনে সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। কিন্তু এখন শি যেভাবে চলেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তার কর্তৃত্ব আরো বেশি। আগে নিয়ম ছিল দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু শি যাতে এই পদে আরো বেশি সময় ধরে থাকতে পারেন, তার জন্য ২০১৮ সালে নিয়ম বদল করা হয়েছে। ৬৮ বছর বয়সি শি এখন আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। দলের ভিতরে তার সেরকম কোনো শত্রুও নেই। তার রাজনৈতিক তত্ত্ব এখন 'শি জিনপিং থট' বলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। সেখানে সেনার বদলে দলের নেতৃত্বের পূর্ণ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনের মান উন্নয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
জিএইচ/এসজি(এপি, এএফপি, রয়টার্স)