পার্থর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেবেন না মুখ্যমন্ত্রী?
গৌতম হোড়
সংবাদভাষ্য
২৫ জুলাই ২০২২
অভিযোগ গুরুতর, কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে নথিপত্র। তারপর অভিযোগমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কেন পদে রাখা হচ্ছে পার্থকে?
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের দাপুটে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা বেরোচ্ছে, অভিনেত্রী বলছেন, ওই টাকা মন্ত্রী তাকে রাখতে দিয়েছেন, এরকম ঘটনা সাম্প্রতিককালে হয়নি। সারদাকাণ্ডে এরকমভাবে কোনো মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতা বা তার ঘনিষ্ঠের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে এত টাকা উদ্ধার হয়নি। নারদ-কেলেঙ্কারিতে নেতাদের টাকা নেয়ার দৃশ্যের ভিডিও আমরা দেখেছি, কিন্তু সে সামান্য কয়েক লাখ টাকা। সেটাও তারা দলের কাছে জমা করেছেন বলে দাবি করছেন। এরকম প্রায় ২২ কোটি টাকা, ৫০ লাখের গয়না, রাশিরাশি ডলারের কাহিনি সেখানে নেই। ফলে এইভাবে টাকা উদ্ধার ও তা মেশিনে গুনতে রাত কাবার হয়ে যাওয়ার গল্প একেবারে নতুন। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের মতো দাপুটে মন্ত্রী গ্রেপ্তার, বাংলা ও ওড়িয়া সিনেমার অভিনেত্রীর কাছ থেকে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার, শরীর খারাপ নিয়ে মন্ত্রীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, বিচারপতির পর্যবেক্ষণ যে, এসএসকেএম প্রভাবশালীদের নিরাপদ আশ্রয়--গত কয়েকদিন ধরে যা চলছে, তাতে কোথায় লাগে বাংলা সিরিয়ালের গল্প!
কিন্তু এতকাণ্ডের পর তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া এতটা নরম কেন? এতকিছুর পরেও পার্থ এখনো কেন মন্ত্রী, কেনই বা তিনি তৃণমূলের মহাসচিব? তাকে কেন ওই দুই পদ থেকে সরানো হলো না? এতদিন ধরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠতে বসতে প্রায় প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী রাজ্যের মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি করার জন্য সিবিআই, ইডি-কে পিছনে লাগিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু অন্তত এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা পাওয়া গেল। আমরা জানি, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত কেউ অপরাধী হন না। ততদিন পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়কে আমরা একবারের জন্যও অপরাধী বলছি না, বলতে পারিও না। তিনি অভিযুক্ত।
এসএসসি কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রী গ্রেপ্তার, বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি
দীর্ঘ জেরার পর গ্রেপ্তার করা হলো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এসএসএসি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে। পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার। তার দাবি, পার্থই টাকা রাখতে বলেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শুক্রবার সকাল থেকে জেরা
শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র অফিসাররা পৌঁছে যান পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে। পার্থ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ঘুম থেকে তুলে শুরু হয় জেরা ও তল্লাশি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা
গ্রেপ্তার করার আগে ২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা করে ইডির অফিসাররা। শুধু পার্থের বাড়ি নয়, মোট ২০টি জায়গা তল্লাশি চালান ইডি-র কর্মকর্তারা। প্রায় ৯০ জন ইডি কর্মী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাতে থাকেন। উপরের ছবিতে কলকাতার নাকতলায় পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের বাড়ি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার
তল্লাশির সময় অভিনেত্রী ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্য়ায়ের ফ্ল্যাট থেকে ২২ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। টাকা অর্পিতার শোয়ার ঘরের আলমারিতে চটের বস্তায় রাখা ছিল। অর্পিতা ইডি-র অফিসারদের জানিয়েছেন, পার্থই তার কাছে টাকা রেখেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাতভর টাকার হিসাব
ইডি-র অফিসাররা ব্যাংক থেকে দশটি টাকা গোনার মেশিন ও কর্মীদের নিয়ে আসেন। সারারাত ধরে টাকা গোনা হয়। দেখা যায়, ২২ কোটি টাকা আছে। তাছাড়া ৫০ লাখ টাকার সোনার গয়না ও প্রচুর ডলার পাওয়া যায়। বেশ কিছু নথিপত্রও নিয়ে গেছে ইডি। অর্পিতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। উপরের ছবিতে অর্পিতার দক্ষিণ কলকাতার আবাসনের ফ্ল্যাটের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কীসের টাকা
আদালতে ইডি জানিয়েছে, অর্পিতা এসএসসি-তে বেআইনি নিয়োগের সঙ্গে জড়িত। তিনি অন্যতম চক্রান্তকারী। তার বাড়িই ছিল নিয়োগের আখড়া। সেই নথিপত্র ইডি পেয়েছে। মন্ত্রীর নামের সরকারি খামও পাওয়া গেছে। অর্পিতা ইডিকে জানিয়েছে, টাকাটা পার্থ চট্টোপাধ্যায তাকে রাখতে দিয়েছিলেন। তিনি এনিয়ে কিছুই জানেন না। ইডি এখন অর্পিতার বাড়ি থেকে পাওয়া বিদেশি মুদ্রা নিয়েও আলাদা মামলা করতে পারে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কে এই অর্পিতা?
অর্পিতা মুখোপাধ্যায় অভিনেত্রী। তিনি বাংলা ও ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাছাড়া তিনি নেল আর্ট করতেন। পার্থর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ফোনে অর্পিতা সারাদিন কথা বলতেন বলে অভিযোগ। তিনি দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী দুর্গাপুজোর সঙ্গেও জড়িত। এই পুজোর সঙ্গে পার্থও য়ুক্ত।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলছেন অর্পিতার মা
মেয়ের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে তার মা মিনতি বলেন, ‘‘বাবা-মা যা চাইবে ছেলেমেয়ে কি সেটাই করবে? সেরকম হলে তো মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম। ওর কথা খবরে শুনেছি। তবে অর্পিতা এই কাজ করেছে কি না, সেই সত্যাসত্যও বিচার করা হবে।’’
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থ হাসপাতালে
গ্রেপ্তার করার পর পার্থকে নিজেদের হেফাজতে রাখে ইডি। তারপর আদালতে পার্থ জানান, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। তখন আদালত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলে। এসএসকেএম হাসাপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। ইডি অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ইডির দাবি মেনে
ইডি পরে কলকাতা হাইকোর্টে জানায়, পার্থকে কল্যাণীর এইমসের চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখুন। কিন্তু বিচারপতি বলেন, কল্যাণীর এইমসের উপর তার ভরসা নেই। পরে তিনি নির্দেশ দেন, ভুবনেশ্বরের এইমসে পার্থর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তিনিকেতনে পার্থর বাড়ি?
শান্তিনেকতনে ছয়টি বাড়ি পার্থর বলে অভিযোগ উঠেছে। তারমধ্যে একটি বাড়ির কেয়ারটেকার বলেছেন, একটি বাড়িতে পার্থর আসা-যাওয়া ছিল। একটি সাত বিঘের জমিও পার্থর বলে অভিযোগ। তবে সরকারি আধিকারিকরা বলেছেন, তারা খোঁজ না করে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থর বিরুদ্ধে অভিযোগ
পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তখন এসএসসি কেলেঙ্কারি হয়। পরীক্ষা দিয়ে যারা উঁচু স্থান পেয়েছে, তাদের চাকরি না দিয়ে, পয়সা দিয়ে নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। এই নিয়োগের বিরুদ্ধে কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই অভিযোগের তদন্ত করছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া
পার্থ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম বরিষ্ঠ মন্ত্রী। মমতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সৈনিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হামেশাই অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে রাজ্যের নেতাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু পার্থকে গ্রেপ্তার করার পর তৃণমূলের বক্তব্য, অভিযোগ প্রমাণ হলে দল ও সরকার ব্যবস্থা নেবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সিপিএমের প্রতিক্রিয়া
সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে এসএসসি চাকুরিপ্রার্থীদের হয়ে মামলা লড়ছেন। বিকাশরঞ্জনের প্রতিক্রিয়া হলো, ''পার্থ হচ্ছেন দাবার ঘুঁটি, ইডির উচিত হরিশ চ্যাটার্জি রোডে তল্লাশি করা। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে।'' তার দাবি, ''ইডি যেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে ধরবে, সেদিন পুরো দুর্নীতি সামনে আসবে।'' সিপিএম কর্মীরা এখন বিভিন্ন জেলায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Abp Photo/Sudipta Bhowmick
বিজেপি, কংগ্রেসের অভিযোগ
বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এসএসসি নিয়ে বিক্ষোভ-মঞ্চে যান। তিনি টুইট করে পার্থ ও অর্পিতা নিয়ে সোচ্চার হন। দিলীপ ঘোষও তাই। কংগ্রেসও এসএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। অর্পিতার দাবি, সেই টাকাটা পার্থই তাকে রাখতে দিয়েছিলেন। এই দাবি যদি সত্যি হয় তো, পার্থের বিরুদ্ধে অভিযোগটা খুবই গুরুতর। সেই সঙ্গে ইডি আদালতে জানিয়েছে, অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে মন্ত্রীর নামাঙ্কিত সরকারি খাম এবং এসএসটি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটাও গুরুতর অভিযোগ এবং এই ঘটনাপ্রবাহের পর তো একটা প্রত্যাশা থেকে যায়। হয় পার্থ নিজে যতদিন নির্দোষ প্রমাণিত না হচ্ছেন, ততদিন দল ও সরকারের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন অথবা মুখ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবস্থা নেবেন। কারণ, গণতন্ত্রে তো এটাই প্রত্যাশিত যে, নেতারা সন্দেহের উপরে থাকবেন। আর এসএসটি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও তো নতুন নয়।
আর ভারতীয় রাজনীতিতে এরকম উদাহরণ যে নেই তা নয়। জৈন হাওয়ালা মামলায় লালকৃষ্ণ আডবাণী অভিযুক্ত হওয়ার পর ঘোষণা করেন, অভিযোগমুক্ত না হলে তিনি আর সাংসদ হবেন না। সাংসদ ও দলের সভাপতি পদ তিনি ছেড়ে দেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ভুষি কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কাশীকান্ত মৈত্র সহ দুই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন সিদ্ধার্থ। ইউপিএ আমলে একের পর এক মন্ত্রী ও সাংসদ অভিযুক্ত হয়ে হয় মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন বা তাদের ছাড়তে বলা হয়েছে। সেই তালিকায় এ রাজা সহ অনেকের নাম রয়েছে।
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
তারা রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের তোয়াক্কা করেন না। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত নারী প্রতিদিন বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি এক বাবা। এসএসসি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন প্রতিদিন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তিন দফায় আন্দোলন
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে ২০১৯ সালের প্রথম দফার আন্দোলন ২৯দিনের মাথায় তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। আশ্বাস ফলপ্রসূ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার আন্দোলনে বসেন চাকরিপ্রার্থীরা। আন্দোলন চলে ১৮৭ দিন। বর্ষণমুখর রাতের অন্ধকারে দ্বিতীয় দফার সেই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। অবস্থান মঞ্চ থেকে আন্দোলনকারীদের সমস্ত জিনিসপত্র সমেত তুলে দেয়া হয়। এখন চলছে তৃতীয় দফার আন্দোলন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সব বাধা উপেক্ষা করে
তৃতীয় দফায় বিগত সাতমাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই আন্দোলন। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে এই শামিয়ানার নীচে আন্দোলনরত কয়েকশত চাকরিপ্রার্থী নারী পুরুষ। প্রথমদিকে শামিয়ানা টাঙানোর অনুমতিও ছিল না। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে তীব্র রোদেই অবস্থান করে আসছিলেন একঝাঁক তরুণ তরুণী। পরবর্তীকালে লালবাজার থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শামিয়ানা টাঙানো হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, বাসটার্মিনাসের শৌচাগার পয়সা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। নারী-পুরুষের জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মাথা গোঁজার ঠাঁই
রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই অবস্থানে প্রতিদিন সামিল হন চাকরিপ্রার্থীরা। কেউ কেউ প্রতিদিন যাতায়াত করেন আবার অনেকে এই আন্দোলনের স্বার্থে বাড়িঘর ছেড়ে দিনের পর দিন এখানেই পড়ে আছেন। কোনোদিন আত্নীয়-স্বজন, কোনোদিন বন্ধুর বাড়িতে রাতটুকু থাকেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও
একসঙ্গে দুইটি লড়াই লড়ছেন বীরভূমের সোমা দাস। এসএসসি দুর্নীতির পাশাপাশি ব্লাড ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও তার লড়াই। দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি সম্পূর্ণ হলেও তৃতীয় দফার কেমো নিতে হতে পারে। এই আন্দোলন চলাকালীন তার চিকিৎসাও চলেছে। সোমবার তাকে সহকারী শিক্ষিকার চাকরি দেয়ার নির্দেশ দেয় শিক্ষা দফতর, কিন্তু তিনি তার প্রাপ্য সরকারি চাকরিটি নেবেন ঠিকই, সঙ্গে আন্দোলনও চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্তান হারানো মইদুল
যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের প্রেসিডেণ্ট মইদুল ইসলাম। আন্দোলন চলাকালীন সন্তান হারিয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তিনি পুত্রসন্তান লাভ করেন। আন্দোলনের ব্যস্ততায় সদ্যোজাতের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করাতে পারেননি। আট দিনের মাথায় মারা যায় শিশুপুত্রটি। মইদুল এখনো বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হারাতে হলো টিউশন
পিয়ালী সরকারের সামান্য যে কয়টা প্রাইভেট টিউশন ছিল, এই আন্দোলনের ফলে সে সব যেতে বসেছে। বিক্ষোভ দেখানোর জন্য কামাই হয়ে যায় টিউশন। ছাত্রছাত্রীর বাবা-মা রুষ্ট হন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুলেখার লড়াই
জুলেখা মণ্ডলের বাড়ি নদিয়ার তেহট্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা সম্ভব হয় না। পরিচিত কারো বাড়িতে রাতটুকু কাটিয়ে আবার ধরণামঞ্চে ফেরেন। বাবা দর্জির কাজ করতেন, পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে কাজও বন্ধ হয়েছে। জুলেখার একার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব। রোটেশন পদ্ধতিতে যখন বাড়ি যান, তখন পড়ান। ছাত্র সংখ্যা কমে গেছে আগের থেকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত
অর্পিতা হাজরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বাড়ি। ধরণামঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য প্রতিদিন সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত করতে হয়। ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না করে তারপর আসেন, আবার বাড়ি ফিরে ১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে পড়তে বসেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়েছেন। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে সারারাত পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন। এখন প্রতিবেশীদের কটাক্ষ শুনতে হয়, সত্যি যদি পাশ করতো নিশ্চয়ই চাকরি পেত”
ছবি: Subrata Goswami/DW
পড়ানো সেরে বিক্ষোভে
হাবড়ার জয়া খাঁ। বাবা মা আর মেয়ে এই তিনজনের পরিবার। বাবা মা দুইজনেই অসুস্থ। সকালে ছাত্র পড়িয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। পাঁচটা পর্যন্ত থাকেন, আবার বাড়ি ফিরে টিউশনি করাতে চলে যান। একটু ভালো খবরের অপেক্ষায় বসে থাকেন বাবা মা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
স্বামী-সন্তান নিয়ে
নাজমুন নাহার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। উত্তর চব্বিশ পরগণায় বাড়ি হলেও স্কুল বাঁকুড়ায়। ইনিও এসএসসির মেধাতালিকায় রয়েছেন। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন তাই প্রতিদিন বিক্ষোভে যোগ দেন। স্বামী মাহসুজার রহমান চাকরিপ্রার্থী না হলেও স্ত্রীর লড়াইতে তিনিও সামিল। সন্তান নিয়ে অবস্থান বিক্ষোভে উপস্থিত থাকছেন প্রতিদিন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চাষ অবহেলা করে
তপন কুমার মাহাতো জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম সিমলাপাল থেকে ধরণায় এসেছেন। প্রতিদিন যাতায়াত সম্ভব নয় বলে বারুইপুরে অনেকের সঙ্গে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে সামান্য কিছু জমি রয়েছে, তাতে চাষবাস চললেও এই আন্দোলনের ফলে তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। বন্ধুদের থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তপন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আয়ুষির ক্ষোভ
দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা আয়ুষি দাসের ক্ষোভ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছের মানুষ হয়ে ফেল করা প্রার্থীরা, এমনকি পরীক্ষা না দেওয়া লোকজনও চাকরি করছে, আর তারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন”
ছবি: Subrata Goswami/DW
অভিযোগ ও বিক্ষোভ
ইংরাজি বিষয়ের চাকরিপ্রার্থী পলাশ মণ্ডল। বললেন, যারা ওয়েটিং লিস্টে থাকল আর যারা এমপ্যানেলড হলো, কেউ জানেনা আসল রহস্যটা কী। পুরোটাই ধোঁয়াশা। যারা পাশ করেছে তারাও জানেনা কত নম্বর পেয়েছে আর যারা ফেল করেও চাকরি করছে তারা জানেনা কত তাদের নম্বর”
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত তৃণমূলনেত্রী সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। অথচ, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তার ছিল। এর আগে নারদা ও সারদায় দলের অনেকে অভিযুক্ত হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় অবিচল ছিলেন। ভোটের সময় দেখা গেছে, মানুষের মনে সেই অভিয়োগ ছায়াপাত করেনি। তারা আবার বিপুল ভোটে মমতাকে জিতিয়েছেন।
কিন্তু সেই পাবলিক পারসেপশন বা জনধারণা বদলাতেও তো সময় লাগে না। যেমন রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফর্সের অভিযোগ সারা দেশে এমনভাবে ছড়িয়ে যায়, বাচ্চা ছেলেরা পর্যন্ত বলতে থাকে, গলি 'গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'। পরে রাজীব যে টাকা নিয়েছেন, আদালতে এমন প্রমাণ হয়নি। ফলে কখন যে মানুষের ধারণা কোন পথে চলবে, তার কোনো সরল অঙ্ক নেই। তবে সেই ধারণার জন্য বসে না থেকে আগেই যদি ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং বলা হয়, আদালত নির্দোষ বলা না পর্যন্ত তিনি আর পদে থাকবেন না, তাহলে তৃণমূলনেত্রীর ভাবমূর্তি বাড়ত, ঠিক গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে চলা যেত এবং এটাও বোঝা যেত, গুরুতর অভিযোগ উঠলে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ব্যবস্থা নিতে পিছপা হন না।
রাজনীতিতে তো অভিযোগ ওঠে, উঠবেই। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে তার বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি নাকি কলকাতার স্টিফেন হাউসের মালিক। প্রচুর দুর্নীতি করেছেন। আর মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর দেখা গেল, তার সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই নিছক অভিযোগ হলে এত কথা বলার দরকার হত না।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অভূতপূর্ণ। তাই চক্রান্তের তত্ব দিয়ে তাকে ঢাকার চেষ্টা করে লাভ হবে না। বরং গত কয়েকদিন ধরে টিভি ও ভিডিওর কল্যাণে মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কাহিনি ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। অন্তত এখন তো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে চলুক শাসক দল। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছি, রাজনীতির মধ্যে আর কোনো নীতি প্রায় অবশিষ্ঠ নেই। তাও আমাদের মনে হয়, সব নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি। এরকম ক্ষেত্রে দল উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নেবে। না হলে যে সন্দেহ ক্রমশ বাড়বে, বাড়তেই থাকবে।