এত বছরেও শান্তি চুক্তি কেন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি? যতদিন না এর কারণ নির্ণয় করা যাবে ততদিন পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের আলাপ করে কোনো লাভ হবে না।
বিজ্ঞাপন
আলাপটা শুরু করা যাক এক সিনেমার বরাত দিয়ে।
২০১৮ সালে নির্মিত ভারতীয় সিনেমা ‘আইয়ারি'র একটি দৃশ্যে কাশ্মীরে মোতায়েন মেজর তার ইউনিট চিফ কর্নেলকে বলেন, ‘‘আচ্ছা স্যার, এতসব জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন, সবাই মিলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করলেই তো পারে!''জবাবে কর্নেল তাকে বলেন, "কোনো সমস্যা থেকে যদি অনেকের ফায়দা হয়, তাহলে সেটা সমাধান করতে হয় না, জিইয়ে রাখতে হয়। কাশ্মীর কোনো একটি জায়গার নাম না, এটা পুরোদস্তুর এক ইন্ডাস্ট্রি। এখানে অনেক ধরনের ব্যবসা চলছে।”
এই কথোপকথনের এক পর্যায়ে তাদের গাড়িতে হামলা হয়। কর্নেলকে রক্ষা করতে গিয়ে মেজর গুলিবিদ্ধ হন, তবে প্রাণে বেঁচে যান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কাশ্মীর না।কাশ্মীরের বাস্তবতাও সেখানে নেই। তিনটি যুদ্ধের পর বিভক্ত হয়ে কাশ্মীর এখন ভারত, পাকিস্তান ও চীনের অংশ। ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সর্বদা তাদের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করে। তাই মাঝে মাঝেই সীমান্তে গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, পার্বত্য অঞ্চলের ভূ-সীমানা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দুই দশক সেখানে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত থাকলেও অস্ত্র ফেলে ১৯৯৭ সালে তারা সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও প্রতিশ্রুতি দেয় চুক্তি বাস্তবায়ন করে সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার।
কিন্তু শান্তির চুক্তির ২৬ বছর পরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে। হামলা,পাল্টা-হামলা, বন্দুক যুদ্ধ এবং খুনাখুনি যেন লেগেই আছে। সম্প্রতি এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়।কয়েকটি ঘটনা-যেমন, কুকি-চীনের আবির্ভাব, তাদের সাথে জঙ্গিদের আঁতাত, পর্যটকদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান এবং সর্বশেষ গত সপ্তাহে দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে আট ব্যক্তি নিহত হলে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে দুই রকমের অভিযোগ শোনা যায়। একটি হচ্ছে, এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলো একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অন্যটি হলো, এসবের পেছনে সরকার বা প্রশাসনের মদত।
পেছনে তাকালে দেখা যায়, শান্তি চুক্তির পরপরই ইউপিডিএফ নামে নতুন এক সংগঠনের জন্ম হয়,যারা পরবর্তীতে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএসের সাথেদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেএসএস ভেঙে তৈরি হয় জেএসএস-এম এন লারমা দল। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে তৈরি হয় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দল। অনেকে মনে করেন, কোনো একটি উদ্দেশ্যে কুকি-চীনকে ব্যাপারটা সামনে আনা হয়েছে। জঙ্গিদের বিষয়টিও অনেকটা সেরকমই।
পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, এসব ভাঙন ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পেছনে প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। পক্ষান্তরে প্রশাসন দায়ী করে স্থানীয় উপদলীয় কোন্দলকে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশায় অনেকে অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলেও শোনা যায়।
এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করে অনেক এনজিও। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে সেখানে গিয়ে বসবাস করছে। বর্তমানে সেটলার ও পাহাড়িদের অনুপাত প্রায় সমান। তাদেরও অধিকার ও স্বার্থের দাবি জোরালো হচ্ছে। এসবের মধ্যে পাহাড়ি গোষ্ঠী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
শান্তি চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারায় ভূমির মালিকানা, বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, চাদাবাজি এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে সেটলার, স্থানীয় প্রশাসন ও পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। শান্তি চুক্তির সময় যে পরিস্থিতি ছিল, তা আর নেই। সেই সময় চুক্তি যত সহজে বাস্তবায়ন করা যেতো, এখন আর তা সম্ভব না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেন এমন প্রায় সকলের মতে, সেখানকার সমস্যাটা আসলে রাজনৈতিক, তাই তার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে। আর এজন্য দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কিন্তু সমস্যার সমাধান না হলে যদি অনেকের ফায়দা হয়, তাহলে সমস্যা হয়ত রয়েই যাবে। তাই পার্বত্য অঞ্চলে কারা কলকাঠি নাড়েন, কেন তা করেন, কী ধরনের ফায়দা পান--এসব নির্ণয় করেই পদক্ষেপ নিতে হবে, নতুবা কোনো কিছুই কাজে আসবে না।
পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর উপায় : পাহাড়ের মানুষেরা যা ভাবছেন
পাহাড়ে এতদিনেও শান্তি ফিরছে না কেন? কী কী করলে শান্তি ফিরতে পারে সেখানে? এ বিষয়ে নিজেদের মত জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কি কি উ মারমা, ছাত্র
আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে সৃষ্টি হয়েছে এসব খুন, গুম, অপহরণ৷ তাই অচিরেই এর রাজনৈতিক সমাধান দরকার৷ সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে সশস্ত্র দলগুলো যে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে, এতে বলি হচ্ছেন আদিবাসীরাই৷ সেটি অচিরেই বন্ধ না হলে আর কত প্রাণ যাবে জানি না! তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি একটা সমাধানের পথ বের করার জন্য সরকারের কাছে আকুল মিনতি করছি৷
ছবি: DW
হ্লা য়ই চিং মারমা, শিক্ষক
আমি মনে করি, স্বাধীনতার পর পাহাড়ে যে অশান্তির দাবানল ছড়ায় সেটি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল৷ বেশ সুন্দর পরিবেশে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল বান্দরবানের ১১টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালি৷ কিন্তু ইদানীং এই জনপদ অশান্ত হয়ে উঠেছে৷ বিপথগামী কিছু সংগঠনের নেতাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তা বিবেচনার আহবান জানাচ্ছি৷
ছবি: DW
বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, সাংবাদিক
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সশস্ত্র দলের উপদল সৃষ্টি হওয়ার ফলে হত্যা,পাল্টা হত্যা, গুম,অপহরণ চাঁদাবাজিসহ নানা ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে৷ এগুলো আমার মনে হয় আসল সমস্যা না৷ মূল সমস্যাটা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা৷ রাজনৈতিক সমস্যাকে যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা না হয়, এই উপসর্গগুলো দূর হবে না৷ রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে দূর করতে হলে অচিরেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে৷
ছবি: DW
খামলাই ম্রো, সাকেব উপজেলা চেয়ারম্যান
আমরা চার-পাঁচ বছর আগে দেখেছি খাগড়াছড়িতে,রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, এখন সেটা বান্দরবানেই বেশি হচ্ছে৷ গত দুই বছর থেকে কেন এভাবে বান্দরবানে শুরু হলো এটা একটু ভাবা উচিত৷ কোনো এক পক্ষ যদি শুধু দায়িত্ব নেয়, তাহলে সমাধান করা সম্ভব না৷ সাধারণ জনগণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারকে সততা ও সদিচ্ছার সাথে এক হয়ে কাজ করতে হবে, না হলে সমাধান আসবে না৷
ছবি: DW
ক্যশৈপ্রম্ন খোকা, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ও চার্চের যাজক
হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ নেয়ার নীতি পবিত্র বাইবেলে যীশু খ্রিষ্টের দেয়া শিক্ষা অনুমোদন ও সমর্থন দেয় না৷ বরং যীশু বলে গেছেন, সবার সাথে সহাবস্থান করতে এবং শত্রুকেও ভালবাসা দিয়ে ক্ষমা করে দিতে৷ ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি রাজনৈতিক বিশেষ স্বার্থ উদ্ধারের পন্থা মাত্র৷ ক্ষমাশীল মনোভাব নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলেই আমরা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের শতভাগ শান্তি, সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে পারবো৷
ছবি: DW
লেলুং খুমি, উন্নয়নকর্মী
জেএসএস ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলন করছে, তা নস্যাৎ করতে অন্যান্য দলগুলো সৃষ্টি করা হচ্ছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংঘাত, মারামারি, খুন, গুম বন্ধ করা দরকার৷ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অসম্ভব কিছু নেই৷ পাহাড়ি—বাঙালি, কিংবা পাহাড়ি-পাহাড়িদের সংঘাতদূর করা কোনো বিষয় না৷ আরেকটা বিষয়- এখানে যে সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন আছে, তাদের নিরপেক্ষতার অভাব আছে।
ছবি: DW
কাজী মুজিবর রহমান, নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান
এই স্বাধীন দেশে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই৷ পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশে থাকতে চাই৷ এই দেশ স্বাধীন করার সময় বহু পাহাড়ি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে৷ তারাও আমাদের ভাই৷ আজ ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরেছে৷ সন্ত্রাসীদের কোনো দল থাকে না, কোনো জাত থাকে না৷ সুতরাং এ বিষয়ে সমাধান হওয়া দরকার, এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার৷
ছবি: DW
লক্ষীপদ দাস, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক
চুক্তির পর পার্বত্য নগরীতে শান্তির সুবাতাস বইছে। পার্বত্য অঞ্চলের আনাচে-কানাচে উন্নয়ন হয়েছে৷ এক সময় দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কিছু ছিল না৷ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রসহ সব জায়গায় আমূল পরির্বতন এসেছে৷ নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণে একদল পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে৷ সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে কেএনএফ-এর কথা৷ আমার মনে হয়, এই সংগঠনটির পিছনে বাইরের কোনো অপশক্তি কাজ করছে।