1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পার্বত্য চট্টগ্রাম: জল, কেন চোখে জল?

 শরিফুল হাসান একজন কলাম লেখক, ও বিশ্লেষক৷
শরিফুল হাসান
৩ অক্টোবর ২০২৫

‘‘একবার আমি গিয়েছিলাম পাহাড়ি অঞ্চল/পাহাড়ি মেয়েটার কি চোখ দুটো ছলছল/ছল, নাকি জল?/ মেয়ে তুই বল, জল, কেন চোখে জল?''

কাপেং ফাউন্ডেশন চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছিল, সেখানে দেখা গেছে, এই সময়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের ওপর ২৪টি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১টি ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, তিনটি সমতলে। ছবি: Abu Sufian Jewel/ZUMA/picture alliance

কোক স্টুডিও বাংলার সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয় গান ‘বাজি'র এই কথাগুলো, কিংবা ওই গানে আদিবাসী বাদ্যযন্ত্রের মাধুর্য্য শুনতে শুনতে আপনি যদি জানেন, এক কিশোরিকে ধর্ষণের প্রতিবাদে অবরোধ চলাকালে খাগড়াছড়িতে গুলিতে তিনজন মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, পরিবারগুলোতে চলছে আহাজারি, বাড়ি পুড়েছে অনেক মানুষের, কান্না থামছে না তাদেরও, তখন রূপক অর্থে হলেও বোধহয় বোঝা যায় কেন পাহাড়ের মানুষের চোখে জল! আচ্ছা, পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলো তা-ও তো ২৮ বছর!

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি। সবাই আশা করেছিল এবার বুঝি সহিংসতা আর চোখের জল থামবে৷ কিন্তু জটিল রাজনীতি আর নানা মারপ্যাচে শান্তি তো আসেইনি, উল্টো গত ২৮ বছরে বারবার হামলা, পাল্টা হামলা, সহিংসতা হয়েছে। প্রাণ গেছে শত শত মানুষের। এই তো ২০১২  ও ২০২৪ সালের এই সেপ্টেম্বরেই পার্বত্য এলাকায় ভয়াবহ সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো। এই সংঘাত আর প্রাণহানির শেষ কোথায়?

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন খাগড়াছড়িতে  সাম্প্রতিক সংঘাতের পুরো ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়, ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। রাতেই তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওই ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করলেও স্থানীয়রা ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরো তিনজনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা' ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেয়। সেই দাবি পুরণ না হওয়ায় খাগড়াছড়িতে তারা অবরোধ ডাকে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷ এই অবস্থায় ২৭ সেপ্টেম্বর মহাজনপাড়ায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হলে কয়েকজন আহত হয়। পরিস্থিতির অরো অবনতি হয় ২৮ সেপ্টেম্বর।

ওইদিন বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। তিনজনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। এরা হলেন, উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যান পাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামেসু বাজার বটতলার তৈইচিং মারমা (২০)। এছাড়া সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। এ সময় গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনার কয়েকদিন পর গণমাধ্যমে যেসব খবর ও ছবি এসেছে, তাতে জানা যাচ্ছে, তিনজনের প্রাণহানির পাশাপাশি আগুনে অনেকের বসতবাড়িপুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বিশেষত, গুইমারার রামেসু বাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। খাগড়াছড়ি শহরসহ আশপাশের উপজেলার লোকজন কাপড় কিনতে এখানে ছুটে আসেন। এবারের আগুনে কাপড়ের দোকানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যাদের বসতবাড়ি গেছে, তাদের আহাজারির শেষ নেই।

২৮ অক্টোবর রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতার সময় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মিবু মারমার বাড়ি ও খাবারের দোকান। গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে মিবু মারমা চোখে জল নিয়ে আফসোস করে বলছিলেন, ‘‘আমার ঘর-বাড়ি না পুড়ে, আমাকেও আগুনের মধ্যে দিয়ে দিতো। তাহলে আর এত দুঃখ–কষ্ট সহ্য করতে হতো না।'' বসতবাড়ি ও দোকান পুড়ে যাওয়ায় সামনের দিন নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন মিবু মারমা। তার বেদনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আগুন থেকে মেয়ের আদুরে বিড়ালকে রক্ষা করতে না পারার কষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘কিছুই নাই, সব ছাই। ছাইয়ের ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। ঢুকেও গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বজনেরা আটকিয়েছিলেন। আমার ঘর-বাড়ি না পুড়ে, আমাকেও আগুনের মধ্যে দিয়ে দিতো, তাহলে আর এত দুঃখ–কষ্ট সহ্য করতে হতো না।''

এমনআহাজারি অসংখ্য মানুষের, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেগুলো ছড়িয়েছে। এর মধ্যেই জানা গেল, খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ওই কিশোরীর শারীরিক পরীক্ষার পর ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে প্রতিবেদন জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। সেখানে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের আলামত মেলেনি বলে জানানো হয়েছে। ফেসবুকেও মেয়েটির নামসহ এই রিপোর্ট ছড়িয়ে পড়েছে।

জুম্ম ছাত্র-জনতার মুখপাত্র কৃপায়ন ত্রিপুরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘এটি সরকারের একটি পরিকল্পিত মনগড়া প্রতিবেদন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের পরীক্ষার প্রতিবেদন এত দ্রুত কখনো দেওয়া হয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। আর বিভিন্নজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে ভুক্তভোগী কিশোরীর ছবি দিচ্ছেন, এটিও একটি অপরাধ। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।''

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের নিপীড়নের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কাপেং ফাউন্ডেশন চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছিল, সেখানে দেখা গেছে, এই সময়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের ওপর ২৪টি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১টি ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, তিনটি সমতলে। ছয়জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুজন নিহত হয়েছেন।

এবার খাগড়াছড়ির গুইমারা যখন পুড়ছিল তখন খাগড়াছড়ি শহরেই বৈঠকে বসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম–বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। বৈঠকে ছিলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশপ্রধানসহ জেলার শীর্ষ কর্তারা। তবে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। অতীতের সরকারগুলোর মতোই এই ঘটনার পর  স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, একটি মহল খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটছে। অথচ এমন একটা ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মানবিক দিক বিবেচনা করে কথা বলতে পারতেন!

সহিংসতার এই ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে, যদিও এমন কমিটি নতুন কিছু নয়। বরং অতীতে এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। প্রতিবার তদন্ত কমিটি হয়, উত্তেজনা  থিতিয়ে আসলে প্রতিবেদনও দেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলো আর কেউ দেখেন না।

রাঙামাটিতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংঘাতের শুরুটা হয়েছিল রাঙামাটি সরকারি কলেজে শ্রেণিকক্ষে বসা নিয়ে, পাহাড়ি ও বাঙালি শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি হয়েছে এমন গুজবকে কেন্দ্র করে। পাহাড়িরা বাঙালি শিক্ষার্থীকে মেরেছে- এমন কথা শহরময় রটে যায়। কিন্তু কখন কীভাবে ঘটনার শুরুটা হয়েছিল, কে কাকে মেরেছিল, তা আর পরে জানা যায়নি। তবে গুজব শুনেই পাহাড়িদের ওপর হামলা শুরু হয়। একাধিক বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। শহরের সুপরিচিত চিকিৎসক সুশোভন দেওয়ান হামলায় আহত হন। সজ্জন এই চিকিৎসক চিরতরে একটি চোখ হারান। আহত হন অনেক পাহাড়ি। ঘটনার পর এর কারণ কিংবা দায়ী কারা, তা নিয়ে আর কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।

এর ঠিক এক যুগ পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালিদের সহিংসতার গণপিটুনিতে ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। রাতে আবার এ ঘটনায় জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তাতে নিহত হন দুই পাহাড়ি যুবক।

ঘটনার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের' ব্যানারে রাঙামাটিতে প্রতিবাদ মিছিল হয়। মিছিলটি রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজারে পৌঁছালে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘাত বাধে। দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করে। পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মিছিলটি পিছু হটে গেলেও সশস্ত্র একটি দল অনিক চাকমা নামের এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। শহরের মূল সড়কের পাশের পাহাড়িদের বসত ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংঘাত চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবারো সেই আহাজারি!

গত বছরের ওই সংঘাতের ঘটনাতেও তদন্ত কমিটি হয়েছিল। ওই কমিটি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে ১৪টি সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে পাহাড়ি–বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি যেমনটা হয়নি অতীতেও।

চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় গতবছরের সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অতীতের ঘটনাগুলোতে কারা আক্রান্ত হয়েছেন, কত ক্ষতি হয়েছে, ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আদৌ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা— এগুলো না জানলে ও না বুঝলে ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবো? তিনি বলেন, ‘‘এখানকার নিরাপত্তা বাহিনীসহ যত ধরনের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, সবখানে নিরঙ্কুশ বাঙালি প্রাধান্য। তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য কোথায় থাকলো? এসব বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে কি পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে নিরপেক্ষতা অবলম্বন সম্ভব? ইতিহাস তো তা বলে না! ফলে, এখানে একটি মিশ্র বাহিনী গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের এবং ১৯৮৯ থেকে এ বিষয়ে আইনি বিধানও রয়েছে। যেখানে পাহাড়ের প্রতিটি জাতিসত্তার মানুষের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হলো না।''

পাহাড়ের অধিকাংশ নেতা মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই, বরং এই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য সমস্যার সমাধানের সূত্র নিহিত রয়েছে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের পর বিভিন্ন সরকার এসেছে এবং গেছে, কিন্তু কোনো সরকারই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি যেই আওয়ামী লীগ সরকার এটি স্বাক্ষর করেছিল, তারাও সর্বশেষ ২০০৯ থেকে ২০২৪, টানা প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকলেও মূলধারাগুলোকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল।

ফলে, চুক্তিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বেদখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও সেনাশাসন প্রত্যাহার, শুধু স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সেই তালিকার মাধ্যমে জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা—ইত্যাদির অঙ্গীকার থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি।  ২৮ বছর পরেও ভূমি বিরোধ অমীমাংসিত, ভূমি কমিশন কার্যত কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। জমি ফেরত পাওয়ার জন্য পাহাড়ি পরিবারগুলোর দাখিল করা ২৬ হাজার মামলার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। বরং, নানা সংঘাত-সহিংসতা চলেছে।

অন্তর্বর্তী এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার অনুরোধ জানিয়ে গতবছরের ২৪ নভেম্বর চিঠি দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন। তাতে সাত দফা দাবি জানানো হয়, যার মধ্যে প্রথমটি হলো চুক্তি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট সময়সীমাভিত্তিক একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

 এছাড়া চুক্তির বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাহাড়ের শাসনকাঠামো বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন, ভূমি অধিকার এবং ভারত থেকে আগত পাহাড়ি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও উন্নয়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। তবে গত এক বছরে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে একটি জাতীয় পর্যায়ে পরিবীক্ষণ কমিটি আছে। অন্তর্বর্তী সরকার এটি পুনর্গঠন করেছে। পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আহ্বায়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা ও শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এবং প্রয়োজনে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। তবে গত ১৯ জুলাই এ কমিটির প্রথম ও একমাত্র বৈঠক হয়। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ বলতে এই একটি বৈঠক।

গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচ পাতাসহ একটি গাছের গ্রাফিতি পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই পাঁচ পাতার নাম ছিল, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসী।' এতে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ'।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে এই গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদ জানিয়ে তা সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি' নামে বাঙালিদের (মূলত পাহাড়ের অভিবাসিত) একটি সংগঠন। এক পর্যায়ে সেটি সরিয়েও নেয় এনসিটিবি। এর প্রতিবাদে ঢাকায় থাকা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে ১৫ জানুয়ারি মতিঝিলের এনসিটিবি ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে গেলে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন।

আহতদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। পরে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়কও হন। রুপাইয়া তখন বলেছিলেন, ‘‘রাজধানীর বুকে এমন হামলা হবে তা কোনোদিন ভাবিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা ছিল, আমাদের ওপর সহিংসতা কমবে; কিন্তু আচরণে হতাশ হয়েছি।''

নয়মাস পর খাগড়াছড়ির ঘটনায় একইরকম হতাশা শোনা গেল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) অলীক মৃর কথাতেও। খাগড়াছড়িতে তিনজনের মৃত্যুর পর এনসিপি থেকে তিনি পদত্যাগ করে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘খাগড়াছড়িতে আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণ, আদিবাসীদের ওপর হামলা, আদিবাসীদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও তিনজন আদিবাসীকে হত্যার ঘটনা নিয়ে এনসিপির নীরবতা এবং ধর্ষণ নিয়ে এনসিপির নেতা হান্নান মাসউদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদে পদত্যাগ করছি।''

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, খাগড়াছড়ির গুইমারায় সংঘটিত ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনের আশ্বাস ও উদ্যোগের প্রতি আস্থা রেখে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবকে সম্মান জানিয়ে মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত অবরোধ স্থগিত করা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল আছে। তবে অবরোধ প্রত্যাহার করায় দূরপাল্লার যান চলাচল শুরু হয়েছে। খুলেছে দোকানপাট। জীবনের নিয়মে হয়তো আগামী কয়েকদিনেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

তবে নিহত আথুই মারমা, আথ্রাউ মারমা আর তৈইচিং মারমার পরিবারে যে আর্তনাদ সেটি খুব সহজে থামছে না! বছরে বছরে এভাবে সংখ্যাটা শুধু বাড়ে! পাহাড়ের কান্না আর থামে না। তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলে, রাষ্ট্র এবং সবাই মিলে চাইলে হয়তো সেই চোখের জল থামতো! প্রশ্ন হলো আর কত চোখের জলে সেই বোধোদয় হবে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ