পার্বত্য শান্তি চুক্তি : ২৫ বছরে প্রথম শর্তই পূরণ হয়নি
২ ডিসেম্বর ২০২২![১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল](https://static.dw.com/image/63963361_800.webp)
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মূল বিষয় ছিল পাহাড়ি জনগণের ভূমির অধিকার, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার৷ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৭২টি বিষয়ের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে৷ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান মিলিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ এই এলাকার জন্যই জন্য শান্তি চুক্তি করা হয়৷
কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতারা দাবি করছেন, ৭২টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র ২৫টির বস্তবায়ন হয়েছে৷ তারা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘আমরা ক্রমাগত লক্ষ্য করছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে কেবল বন্ধই রাখা হয়নি, একই সাথে চুক্তি স্বাক্ষরকারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা মামলা, ধরপাকড়, হামলা ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে কোণঠাসা ও নস্যাৎ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার ও শাসকগোষ্ঠী৷’’
তাদের অভিযোগ, ‘‘পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতায় গড়ে ওঠা ইউপিডিএফের পাশাপাশি জনসংহতি সমিতি (সংস্কারপন্থি), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (বম পার্টি), পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সংগঠনের বিরুদ্ধে তেমন তৎপরতা দেখা যায় না৷’’
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা মনে করেন, ‘‘পার্বত্য ভূমি সংস্কার ছাড়া পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ আর চুক্তি অনুযায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো এখানো প্রত্যাহার হয়নি৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত আছে৷’’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও তারা কাজ করতে পারছে না৷ গত ৭ সেপ্টেম্বর কমিশন সদস্যরা সেখানে যাওয়ার পরও সন্ত্রাসীদের কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হন৷’’ এখানে বঙালি সেটলারদের দিয়ে ভূমি সংস্কারের পরিকল্পিতভাবে বিরোধিতা করানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন৷
জনসংহতি সমিতি দাবি করছে, বিগত ২৪ বছরেও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের দুই তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের ভূমি ফেরত পায়নি৷ তাদের ৪০টি গ্রাম, ভিটে-মাটি ও জায়গা-জমি এখনো সেটলার বাঙালিদের পুরো দখলে রয়েছে৷ ভূমি বিরোধ নিয়ে প্রত্যাগত পাহাড়ি ও সেটলার বাঙালিদের মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দেয়৷ নিজ জায়গা-জমি ফেরত না পাওয়ায় জুম্ম জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন যাপন করছে৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার উন্নয়নে দুই হাজার ৮১৪টি সেট কমিউনিটি সোলার সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে৷ আর হোম সোলার প্যানেল বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার৷ গত ৭ নভেম্বর পার্বত্য এলাকার জন্য ৪২ টি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে৷ আর আগে থেকেই ওই তিন জেলার উন্নয়নে অনেক কাজ করা হয়েছে৷ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে৷ চলতি অর্থ বছরে পার্বত্য তিন জেলায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬৯টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে৷ ওই এলাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হয়েছে৷
তবে এ প্রসঙ্গে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘‘চুক্তির ৭২টি পয়েন্ট আছে৷ কিন্তু পয়েন্ট হিসাব করে বাস্তবায়নের হিসাব করা হাস্যকর৷ চুক্তির প্রথম ধারাই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে আদিবাসী অধ্যুষিত৷ কিন্তু তারা তো সেখানে এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে৷ কথিত উন্নয়নের নামে তো তারা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে৷ সরকার উন্নয়নের নামে পার্ক, সাফারি পার্ক, ইকো পার্ক, পর্যটন স্পট, হোটেল-মোটেল করে আদিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে৷’’
সন্তু লারমা তার পনছড়ির বাড়িতে আজও যেতে পারেননি৷ তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘আমি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু৷’’
তার কথা, ‘‘আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে৷ পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, ভূমি সংস্কার বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদ হওয়ার কথা হয়েছে৷ এগুলোর নেতৃত্বে আদিবাসীরা আছেন৷ কিন্তু আইন ও বিধি প্রণয়ন কি হয়েছে? হয় নাই৷ আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার তারা পায়নি৷ মূল কথা হলো, অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা দরকার, তা হয়নি৷ ভূমি সংস্কার না করে কৌশলে আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তর করা হচ্ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারই পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছে৷ তাদেরই এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব৷’’
সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা বলা হয়েছে মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ বা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত তার ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ' শিরোনামের এক গবেষণা গ্রন্থে বলছেন, ‘‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা ৪৭ শতাংশ৷ গত তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে৷’’
২০২০ সালের ছবিঘরটি দেখুন...