নর্মান্ডির বেক এলুঁই খামার ফ্রান্সের সেরা পার্মাকালচারের খামার, এক ফরাসি দম্পতির আশ্চর্য সাফল্যের কাহিনি৷ পার্মাকালচার বলতে ঠিক অরগ্যানিক কৃষি নয়, তবে টেকসই কৃষি বোঝায় – যা থেকে আবার তিন থেকে চারগুণ বেশি ফসল পাওয়া যায়!
বিজ্ঞাপন
ফ্রান্সের সেরা বিকল্প কৃষি খামারটি পাওয়া যাবে নর্মান্ডি অঞ্চলে৷ শার্ল ও তাঁর স্ত্রী পেরিন অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার ২০০৩ সালে জমিটুকু কিনে সেখানে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষ করার পরিকল্পনা করেন৷ পেরিন শোনালেন, ‘‘আমরা যখন শুরু করি, তখন সবাই বলত, অরগ্যানিক পণ্য দিয়ে তো আর সারা দুনিয়ার খিদে মেটানো যাবে না৷ আমরা কিন্তু ঠিক তাই ভাবতাম৷ তবে প্রাথমিকভাবে আমরা নিজেদের ও আমাদের পরিবারবর্গের জন্য অরগ্যানিক খাবারের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম৷'' শার্ল অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার যোগ করলেন, ‘‘গোড়ায় আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না৷ লোকে ভাবত, আমরা শহর থেকে আসা দুই ভাবুক৷ কিন্তু ধীরে ধীরে ওরা আমাদের বাগানের ফলন দেখে চমকে গেছে৷''
পেরিন প্রথমে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষের চেষ্টা করেন, কিন্ত তা বিশেষ সফল হয়নি৷ তখন তিনি পার্মাকালচার আবিষ্কার করেন, যার উৎস অস্ট্রেলিয়ায়৷ পার্মাকালচারের লক্ষ্য হল কৃষিতে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘বায়োজিওকেমিক্যাল' বৃত্ত সৃষ্টি করা, যেগুলি তাদের পরিবেশকে নিজের মতো করে গড়ে নেয় ও তা থেকে বাঁচতে পারে৷ শার্ল ও পেরিন এভাবে বর্তমানে ১,৪০০ বর্গমিটার জমিতে প্রায় ৭০ ধরনের সবজির চাষ করেন৷
আর্বান ফার্মিং: শহরে চাষ
বাড়ির বাগানে মুরগি পোষা, কিংবা ছাদ কি বারান্দার টবে সবজি ফলানো, এ ধরণের শহুরে চাষ চলে আসছে বহুকাল ধরে৷ কিন্তু ‘আর্বান ফার্মিং’ আজ একটি বিশ্বব্যাপী প্রবণতা – হয়তো একটি বিশ্বব্যাপীসমাধান৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Lopez
আর্বান ফার্মিং কেন?
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১,০০০ কোটি কিংবা তারও বেশি৷ এর দুই-তৃতীয়াংশ বাস করবে শহরে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে এই পরিমাণ মানুষের খাদ্য জোগাড় করা সহজ কথা নয়৷ সেক্ষেত্রে শহরের মধ্যে চাষবাস সাহায্য করতে পারে৷
ছবি: Imago/UIG
শহুরে চাষি
শহরে যাদের বাস, তাদের প্রকৃতির প্রতি টান কোনো অংশে কম নয়৷ তার খানিকটা মেটে বাগান করতে পেরে৷ কিন্তু আর্বান ফার্মিং মানুষ আর মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা আনে, নতুন চাকরি সৃষ্টি করে, বাড়ায় নগরবাসীদের খাদ্য নিরাপত্তা৷
ছবি: Imago/AFLO/Yoshio Tsunoda
সবুজের স্নিগ্ধ প্রলেপ
ঊষ্ণায়নের ফলে যখন বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে, তখন গাছপালা শহরের তাপমাত্রা কমায়৷ হংকংয়ের ইয়াউ মা তেই একটি প্রাচীন এলাকা৷ ২০১২ সালের মার্চ মাসে সেখানকার নানা ছাদের বাগান মিলিয়ে ‘এইচকে ফার্ম’ সৃষ্টি করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Lopez
ছাদে চাষ
নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন গ্রেঞ্জ হল বিশ্বের বৃহত্তম ছাদের খামার৷ দু’টি ছাদ মিলিয়ে তৈরি এই খামারে বছরে ২২,০০০ কিলোগ্রাম অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন করা হয়৷ এছাড়া খামারটি শহর জুড়ে বাড়ির ছাদে ৩০টি মৌমাছির দল ও মৌচাক পোষে৷ আর্বান ফার্মিংয়ের টেকসই মডেল হিসেবে ব্রুকলিন গ্রেঞ্জ গড়ে ওঠে ২০১০ সালে৷
ছবি: Imago/UIG
ময়লা ফেলার জায়গায় চাষ
নাম হলো ‘প্রিন্ৎসেসিনেনগ্যার্টেন’ বা রাজকুমারীর বাগান৷ বার্লিনের ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকার এই অংশটি অর্ধশতাব্দী ধরে ময়লা ফেলার জায়গা ছিল৷ পরে সেখান থেকে আবর্জনা সরিয়ে অরগ্যানিক সবজি চাষের পোর্টেবল, অর্থাৎ অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া যায় এমন প্লট তৈরি করা হয়৷ সংগঠনটি আজ শহরের ভিতরে অনেক পোড়োজমি বা কনস্ট্রাকশন সাইটেও আর্বান ফার্মিং করে থাকে৷
ছবি: Prinzessinnengärten/Marco Clausen
ছাদে ধান রোয়া
টোকিও-র রোপোঙ্গি হিলস আসলে একটি বিজনেস ও শপিং কমপ্লেক্স৷ তার ছাদে মাটি ফেলে ধানের ক্ষেত করা হয়েছে৷ শহরের অন্যত্র ‘সিটি ফার্ম’ নামের একটি সংগঠন তরমুজ, টমেটো, সয়াবিন ফলায়৷ এছাড়া ধানচাষও করে থাকে৷ সংগঠনের সদস্যরা ধান ঝাড়ার কাজে সাহায্য করতে পারেন, কিংবা জাপানের ‘সাকে’ সুরা বানানোর পদ্ধতি শিখতে পারেন৷
ছবি: Imago/AFLO/Yoshio Tsunoda
বিপদের সময়
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের উপকণ্ঠে এলিনিকো কমিউনিটি গার্ডেন আসলে একটি ‘গেরিলা গার্ডেন’৷ গেরিলা যুদ্ধের মতোই অভাব-অনটনের দিনে গ্রিসের সর্বত্র এ ধরণের বাগান বা খেতখামার গজিয়ে উঠেছে, কেননা মানুষের খাদ্য চাই৷ এলিনিকো বাগানটি যেখানে, ২০০১ সাল পর্যন্ত সেটা ছিল একটা বিমানবন্দর৷ পরে জমি পরিষ্কার করে স্বেচ্ছাসেবীরা এখানে সবজি ও ফলমূল ফলাতে শুরু করেন দুঃস্থ এথেন্সবাসীদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে৷
ছবি: Heidi Fuller-love
7 ছবি1 | 7
পেরিনের ভাষ্যে: ‘‘এখানে কোনো মোনোকালচার নেই৷ আমাদের এখানে সবসময় নানা ধরনের সবজি একসঙ্গে চাষ করা হয়, ভারসাম্য রক্ষার জন্য যা খুব দরকার৷ কাজেই এখানে স্যালাডের সঙ্গে ফুল আর পেঁয়াজ বসানো হয়, কেননা পেঁয়াজের গন্ধে স্যালাডের পোকারা পালায়৷ কেন? খুব সোজা: স্যালাডের পোকারা দেখতে পায় স্যালাড, কিন্তু শোঁকে পেঁয়াজ! তাতে তারা ঘাবড়ে যায়৷ কাজেই সবজিরা নিজেরাই পরস্পরকে বাঁচায়৷''
স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃত্ত
প্রত্যেকটি গাছ বা উদ্ভিদ পোকাদের টানে৷ অপরদিকে অন্যান্য জীবজন্তু পোকা খেয়ে পোকার সংখ্যা কমায়৷ বিরল পাখিরা আবার ফিরে আসতে শুরু করে৷ বেক এলুঁই খামারে পরাগ ছড়ানোর কাজটা মৌমাছিরা নয়, ভোমরারা করে৷ বাগানটা একটা ঝর্ণার ধারে৷ বনের পশুপাখিরা এখানে স্বচ্ছন্দ বোধ করে; সবজি চাষ থেকে যা পড়ে থাকে, তাতেই তাদের চলে যায়, কিছুই নষ্ট হয় না৷ এভাবেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃত্ত তৈরি হয়৷ সার অথবা যন্ত্রের ব্যবহার এখানে নিষিদ্ধ৷ উঁচু ঢিবির মতো সবজির খেতগুলোতে শুধুমাত্র ঝারি দিয়ে পানি দেওয়া যায়৷
শার্ল অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার ব্যাখ্যা করলেন: ‘‘প্রথমে একটা ঢিবি করা হয়; তার ওপরে খুব ঘন করে চারাগাছ বসানো হয়, এমনকি বেশ উঁচু সব চারা৷ এর ফলে গাছেদের একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে৷ নীচের মাটি শিকড়-বাকড়ে ভরে যায়৷ প্রত্যেকটি ঢিবির ওপর একটা মাইক্রো-ক্লাইমেট সৃষ্টি হয়৷ বৃষ্টি হলে মাটি জলে ভেসে যায় না, কেননা শিকড়-বাকড়ে তা ধরে রাখে; ঐ মাটি আবার জীবনে ভরপুর: কেঁচো, জীবাণু, শ্যাওলা৷ আর প্রত্যেকটি ঢিবির এই নিজস্ব ‘জলবায়ুর' ফলে প্রতিবার চাষের সঙ্গে সঙ্গে জমি আরো উর্বর হয়ে ওঠে৷''
পানির উপর হচ্ছে সবজি চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামের বেশিরভাগই বছরের পুরোটা সময় জলাবদ্ধ থাকে৷ এ সব গ্রামের মানুষেরা ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা এবং সবজি উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন৷
ছবি: DW
কৃষকের কৌশল
বছর জুড়েই জলাবদ্ধতা, সাথে কচুরিপানার মিছিল৷ ফলে পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকার নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক উপায়ে কৃষিকাজ কার্যত অসম্ভব৷ তবে বৈরী এই পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে নাজিরপুরের কৃষকরা নিজেদের কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষিকাজ৷
ছবি: DW
ভাসমান কৃষিক্ষেত্র
নাজিরপুরের মুগাঝোর এলাকার জলাভূমিতে ভাসমান কৃষিক্ষিত্র৷ নিজেদের উদ্ভাবিত ‘ধাপ’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন এ সব এলাকার মানুষরা৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে নাজিরপুরে উদ্ভাবিত ভাসমান পদ্ধতির এ চাষাবাদ৷
ছবি: DW
যেভাবে তৈরি হয় ধাপ
নাজিরপুরের পানিতে ডোবা নিম্নাঞ্চল কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জল সহিষ্ণু ঘাসসহ নানান জলজ উদ্ভিদে ভরপুর৷ এ সব জলজ উদ্ভিদকে স্তূপ করে পচিয়ে তারা তৈরি করেন ভাসমান এক ধরণের ধাপ৷ এই ভাসমান ধাপের উপরেই চাষাবাদের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাঁরা৷
ছবি: DW
পুরনো ধারা
কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে জলাশয়ে ভাসমান চাষাবাদ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এ অঞ্চলে৷ কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা জমির চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷
ছবি: DW
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ
ধাপ পদ্ধতির এ চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে৷ রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বললেই চলে৷ ফলে উৎপাদন খরচও কম এবং স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: DW
ভাসমান বীজতলা
জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জলজ ঘাস স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়৷ এগুলো কয়েকদিন ধরে পচানো হয়৷ একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া হয়৷
ছবি: DW
চাষ করা যায় অনেককিছু
ভাসমান এ সব ধাপে সাধারণত লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শশা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ ইত্যাদি শাকসবজি ও মশলার চারা উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা৷ অনেক কৃষক আবার লাল শাক, ঢেঁড়স, হলুদ ইত্যাদিও চাষ করে থাকেন৷
ছবি: DW
নেই কোনো কৃষিঋণের ব্যবস্থা
মুগারঝোরের চাষীদের জন্য কৃষি ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চরা হারে সুদ নিয়ে গরিব এ চাষীরা তাঁদের কৃষি কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন৷ স্থানীয় কৃষক আশুতোষ জানান, সরকার সহজশর্তে ঋণ দিলে তাঁরা ভাসমান এ চাষাবাদের আরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন৷
ছবি: DW
বিক্রি হয় কচুরিপানা
নাজিরপুরের মুগারঝোরে নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ক্রেতার খোঁজে এক বিক্রেতা৷ এক নৌকা কচুরিপানা সাধারণত বিক্রি হয় ২-৩ হাজার টাকায়৷ এছাড়া নাজিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় এসব কচুরিপানার হাটও বসে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
বৌদ্ধদের ‘মান্ডালা' চক্রের আকারে সবজির খেত করার আইডিয়াটা শার্ল পেয়েছেন এশিয়া থেকে৷ সূর্যের সর্বোচ্চ অবস্থানের কথা মনে রেখে ক্ষেতগুলো কাটা হয়েছে৷ এছাড়া জমির স্বাভাবিক এবড়ো-খেবড়ো আকৃতিও ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর ফলে কোদাল চালিয়ে পুরো ক্ষেতটা নতুন করে তৈরি করতে হয়নি৷ শার্ল জানালেন, ‘‘এই খামারে আমরা গড়ে প্রতি বর্গমিটার জমি থেকে ৫৫ ইউরো ফসল পাই৷'' যা কিনা ট্র্যাক্টর দিয়ে চাষ করা প্রথাগত সবজির খামারের প্রায় দশ গুণ!
ভবিষ্যতের কৃষি?
বেক এলুঁই কি তাহলে ভবিষ্যেৎ কৃষির আদর্শ? প্যারিসের জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানের কৃষি বিশেষজ্ঞ ফ্রঁসোয়া লেজার একটি ন'বছর ব্যাপি জরিপে সেটাই পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন৷ জরিপের ফলাফল: বেক এলুঁইতে যে পরিমাণ সবজি ফলে, তা অনুরূপ আয়তনের একটি প্রথাগত খামারের তুলনায় প্রায় তিন থেকে চার গুণ৷
জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানের ছাদের বাগানে বেক এলুঁই-এর এই আশ্চর্য সাফল্যের কারণ অনুসন্ধান করছেন লেজার৷ তিনি দেখেছেন, ‘‘প্রথমত প্রতিটি ক্ষেতে একাধিক ধরনের সবজির চাষ করা হয়৷ বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে সংযোগের ফলে ফলন বাড়ে৷ হাতে করে চারা বসালে, ঘন করে চারা পোঁতা যায়; সেজন্যও ফলন বাড়ে৷ প্রতিটি গাছ যে বেশি ফল দেয়, এমন নয়, কিন্তু গাছের সংখ্যা অনেক বেশি৷ আর যত বেশি গাছ, তত বেশি ফলন৷''
বেক এলুঁই-এর লাভের আরেকটা কারণ: এখানে চাষবাসের খরচা অনেক কম৷ ১৫ জন কর্মচারী আছে বটে, কিন্তু কোনো দামি ট্র্যাক্টর বা যন্ত্রপাতি নেই৷ কৃত্রিম সার, কীটনাশক ও সেচের খরচও বাঁচে৷ খামারের ঘাসপাতা দিয়েই সবজির ক্ষেতগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়৷ তার ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ে৷
বেক এলুঁই খামারের নাম ইতিমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এক টুকরো পোড়ো জমি থেকে এরকম একটি নিসর্গ সৃষ্টি করা মুখের কথা নয়৷ সেই নিসর্গ আবার টেকসই, প্রায় নিজে থেকেই চলে৷
মোনিকা কোভাকসিক্স/এসি
দেশের তরুণরা ঝুঁকছে খামারে
ঢাকা শহরের ভেতরেই একটি খামার৷ সেখানে টার্কি, তিতির ও কোয়েল পাখির ‘চাষ’ বা ‘উৎপাদন’ করা হচ্ছে৷ নিজেদের প্রচেষ্টায় বাড্ডায় চালু হয়েছে এই খামার৷ দেশের ৬৪টি জেলায় তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে৷ ছবি পাঠিয়েছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যেভাবে শুরু
একজন শৌখিন, কৃষিমনস্ক প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও একজন তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেনের যৌথ প্রয়াসে ঢাকার বাড্ডায় গড়ে উঠেছে একটি টার্কি খামার৷ খামারে সার্বক্ষনিক চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন ফার্মাসিস্ট এনামুল হক৷
ছবি: Miraz Hossain
দুবাই থেকে ফিরে খামার
মিরাজ হোসেন জানান, দুবাই থেকে আসার পর কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না৷ পরবর্তীতে অনলাইনে টার্কি সম্পর্কে জানতে পারেন৷ তারপর টার্কি পালনের উপর কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মাত্র ৬ টি টার্কি নিয়ে খামারটি শুরু করেন৷
ছবি: Miraz Hossain
‘টার্কি মিরাজ’
বর্তমানে টার্কি ‘উৎপাদন’ বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রেখেছে ‘মিরাজের টার্কি ফার্ম’৷ এই ফার্মের কারণে মিরাজ আজ সবার কাছে ‘টার্কি মিরাজ’ নামে পরিচিত৷ ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে মাত্র ৬টি টার্কি দিয়ে এই ফার্মটি শুরু করলেও বর্তমানে খামারে ২-৩ মাস বয়সী ১৫০ টি এবং ৭-৮ মাস বয়সি ৪৬ টি টার্কি রয়েছে৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কির আকার
পুরুষ টার্কি স্ত্রী টার্কির তুলনায় বড় এবং অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়৷ একটি পুরুষ টার্কির ওজন হয় ১০-১২ কেজি৷ পুরুষ টার্কির তুলনায় স্ত্রী টার্কি আকৃতিতে ছোট এবং ওজনে কম হয়৷ একটি স্ত্রী টার্কি বছরে ৮০-১০০ টি ডিম দেয়৷ (এই ছবিটি ডয়চে ভেলের)
ছবি: DW/E. Musli
রোগ প্রতিরোধ
অনুকুল পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর ও নিয়মিত খাবার দিলে টার্কি মুরগি রোগাক্রান্ত হয় না৷ ৪ থেকে ৫ বর্গফুট জায়গা রাখতে হবে একটি টার্কির জন্য৷ নিয়মিত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেয়া জরুরি৷ এতে রোগ সংক্রমণ কম হয়৷ চারটি ভ্যাকসিনেশন সিডিউল আছে৷ রানীক্ষেতসহ চারটি রোগের জন্য ভ্যাকসিন দিতে হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
বাচ্চা উৎপাদন
ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ২৮ দিনে টার্কির বাচ্চা উৎপাদন হয় এবং প্রতিমাসে আমার এখানে ২০০ থেকে ২৫০ টি বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে৷ এছাড়া দেশি মুরগির সাহায্যে সনাতন পদ্ধতিতেও ২৮ দিনে বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস
দেশের মানুষের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরনের ক্ষেত্রে পোল্ট্রির পাশাপাশি টার্কি মুরগি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে বলে খামারিরা আশা করছেন৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কি ও তিতিরের দাম
টার্কির একমাস বয়সের একটি বাচ্চার দাম তিন হাজার টাকা, তিতিরের বাচ্চার দাম দুই হাজার টাকা৷ বড় একজোড়া টার্কির দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা৷ এছাড়া প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৫০ টাকায়৷
ছবি: Miraz Hossain
উট পাখি
মিরাজ হোসেন উট পাখিও পোষা শুরু করেছেন৷ এ থেকে লাভজনকভাবে উটপাখি উৎপাদন সম্ভব কিনা তা দেখছেন৷ ছবিতে উট পাখির একটি বাচ্চা হাতে নিয়ে আছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের খামার
সাধারণত একটি ভালো জাতের কোয়েল পাখি বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ টি ডিম দিয়ে থাকে৷ প্রায় প্রতিটি ডিম থেকেই বাচ্চা হয়৷ এই বাচ্চা পরবর্তী ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যেই ডিম দেওয়া আরম্ভ করে৷ এই বয়সের কোয়েল পাখির বাজারে প্রচুর চাহিদা৷ অত্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে কোয়েল পাখির খামার করা যায় এবং খুব দ্রুতই লাভ পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের যত্ন
ঘরের যেখানে পর্যাপ্ত আলো -বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেই কোয়েলের খাঁচা রাখা উত্তম৷ তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, বৃষ্টির পানিতে কোয়েলের খাঁচা যেন ভিজে না যায়৷ ভিজে এবং স্যাঁতস্যাতে জায়গায় রাখলে কোয়েলের রোগ ব্যাধি বেশি হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
আরও কয়েকজন
নুরুল হুদা, পার্থ মজুমদার বাপ্পি এবং শরীফ আব্দুল কাইয়ুমও এ ধরণের খামার করছেন৷ কেবল টার্কি নয় তিতির, কোয়েল পাখির খামার গড়েও সফলতা পেয়েছেন৷ শৌখিন পাখি যেমন ঘুঘু,কবুতর,টিয়া ইত্যাদি পাখিও যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷
ছবি: Miraz Hossain
অন্যদের উৎসাহিত করা
মিরাজের ইচ্ছা বাণিজ্যিকভাবে সারা বাংলাদেশে এই খামারের পরিকল্পনা ছড়িয়ে দেওয়া৷ বর্তমানে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষ টার্কি ফার্ম গড়ে তুলছেন৷ মিরাজ হোসেন টার্কি বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন৷ বেকারত্ব দূর করার জন্য এটা একটা ভালো উদ্যোগ বলে মনে করেন তিনি৷ প্রতি শুক্রবার তাঁর খামারটি পরিদর্শনে আসেন অনেক উদ্যোক্তা৷