১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপানি জঙ্গিবিমান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন নৌ-ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে৷ ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে যুক্তরাষ্ট্র৷ জাপানের প্রধানমন্ত্রী সেখানে আসছেন বটে, কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থনা হয়ত করবেন না৷
বিজ্ঞাপন
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সোমবারেই হাওয়াইতে পৌঁছান৷ অপরদিকে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পরিবার সহ হাওয়াইতে বড়দিনের ছুটি কাটাচ্ছেন৷ আবেই প্রথম জাপানি নেতা যিনি ইউএসএস অ্যারিজোনা মেমোরিয়ালটি পরিদর্শন করবেন৷ জাপানের জনমত যে কতটা এগিয়েছে, এটা তারই প্রমাণ, টুইট করেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা৷
পার্ল হার্বারের উপর জাপানি বিমানবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ২,৪০৩ জন মার্কিনি প্রাণ হারান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর ছিন্নভিন্ন হয়৷ এই আক্রমণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে জনমত পুরোপুরি বদলে যায় ও প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন ডি. রুসভেল্ট অ্যামেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের সপক্ষে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন৷ ইউরোপে তখন দু'বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলেছে৷
মঙ্গলবারের সফরে আবে দৃশ্যত ৭৫ বছর আগে পার্ল হার্বারের উপর জাপানি আক্রমণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন না, কিন্তু তিনি যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন৷ এই প্রতীকী পদক্ষেপের ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে, বলে টোকিওর আশা৷
হাওয়াই যাত্রার আগে আবে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘যুদ্ধের বিভীষিকার কোনোদিন পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়৷ আমি ভবিষ্যতের জন্য এবং জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পুনর্মিত্রতার মূল্যায়ন হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে এই শপথ নিতে চাই৷'' প্রসঙ্গত, ছ'মাস আগে ওবামা যখন প্রথম ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিরোশিমা সফর করেন, তখন তিনিও হিরোশিমার উপর অ্যামেরিকার আণবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি৷
ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা পার্ল হার্বারে আবে ও ওবামার প্রতীকী সফরকে ডোনাল্ট ট্রাম্পের আসন্ন ক্ষমতাগ্রহণের পটভূমিতে দেখছে৷ পত্রিকাটি টুইট করেছে, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘‘ট্রাম্প যে ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন, তা প্রশমন করার চেষ্টা করছেন ওবামা৷''
সোমবার আবে অন্যান্য স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন৷ মঙ্গলবার অ্যারিজোনা মেমোরিয়াল দর্শন করার আগে উভয় নেতা একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের সামনে কিছু প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করবেন৷ পার্ল হার্বার আক্রমণের ভেটারান ও প্রত্যক্ষদর্শীরাও সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন, বলে প্রকাশ৷
এসি/ডিজি (এএফপি, এপি, ডিপিএ)
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
কোনো যুদ্ধে আণবিক বোমার ব্যবহারের একমাত্র উদাহরণ স্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা হামলা চালিয়েছিল তারা, যার বিভীষিকা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Images
প্রথম বোমা নিক্ষেপ
১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট৷ ঘড়িতে বাজছে ঠিক সকাল সোয়া আটটা৷ জাপানের হিরোশিমা নগরিতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান ‘এনোলা গে’ থেকে ছোড়া হয় প্রথম আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’৷ মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় গোটা নগরীর বাড়ি ঘর, দালান কোঠা৷ আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান সেখানকার ২০ ভাগ মানুষ৷ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে লক্ষাধিক৷
ছবি: Three Lions/Getty Images
দ্য এনোলা গে
আদতে হিরোশিমায় বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল ঐ বছরের ১লা আগস্ট৷ কিন্তু টাইফুনের কারণে তা বাতিল করা হয়৷ পাঁচদিন পর ‘এনোলা গে’ ১৩ জন ক্রু নিয়ে হামলার জন্য রওনা হয়৷
ছবি: gemeinfrei
দ্বিতীয় বোমা হামলা
হিরোশিমায় হামলার তিনদিন পর, অর্থাৎ ৯ই আগস্ট, অ্যামেরিকা দ্বিতীয় আণবিক বোমাটি ফেলে নাগাসাকি শহরে৷ আসলে তাদের লক্ষ্য ছিল কিয়োটো৷ কিন্তু এতে মার্কিন প্রতিরক্ষাবাহিনী সায় না দেয়ায় নাগাসাকিকে বেছে নেয়া হয়৷ এই বোমাটির নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’৷ এতে বিস্ফোরক ছিল ২২ হাজার টন টিএনটি৷ বোমা হামলার চার মাসে সেখানে প্রাণ হরান ৭০ হাজার মানুষ৷
ছবি: Courtesy of the National Archives/Newsmakers
কৌশলগত হামলা
১৯৪৫ সালে নাগাসাকিতে ছিল মিৎসুবিশি কোম্পানির ইস্পাত ও অস্ত্র কারখানা৷ সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে হামলা চালানোর টর্পেডোও তৈরি হতো৷ নাগাসাকিতে তখন মাত্র অল্প কয়েকজন সেনা ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হামলা শিকার
বোমা হামলার সময়ই কেবল নয়, তেজস্ক্রিয়তায়ও কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ তেজস্ক্রিয়তা, পোড়া ও ক্ষতের কারণে ১৯৪৫ সালের শেষে কেবল হিরোশিমাতেই নিহত হয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ৷ পাঁচ বছর পরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজারে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
যুদ্ধাপরাধ?
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার পর জাপানিরা আতঙ্কে ছিলেন যে, রাজধানী টোকিওতে হয়ত তৃতীয় হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র৷ তাই আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ঐ হামলা দুটির নির্দেশ দেন৷ তাঁর মনে হয়েছিল এতে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে৷ ইতিহাসবিদরা অবশ্য এ ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন৷
ছবি: AP
পুনর্গঠন
হিরোশিমা নগরীর ‘সিটি সেন্টার’ বোমা হামলায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছিল, যা আবার নতুন করে গড়া হয়৷ কেবল ‘ওটা’ নদীর ধারে দ্বীপটিতে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি৷ সেখানে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ: শান্তি জাদুঘর, শিশুদের শান্তি স্মারক স্তম্ভ, শিল্প ও বাণিজ্য ভবনের ধ্বংসস্তূপ আর শিখা অর্নিবাণ, যেটা জ্বলবে বিশ্বের সব আণবিক বোমা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত৷
ছবি: Keystone/Getty Images
স্মরণের সংস্কৃতি
১৯৫৫ সালে নাগাসাকিতে অ্যাটোমিক বোমার জাদুঘর এবং একটি ‘পিস পার্ক’ বা শান্তি উদ্যান নির্মাণ করা হয়৷ সেখানে গিয়ে অনেকেই বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ করেন৷ এটা জাপানিদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ পারমাণবিক যুদ্ধের নারকীয়তার বৈশ্বিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি৷
ছবি: Getty Images
এক মুহূর্তের নীরবতা
প্রতি বছর হিরোশিমায় এ দিনটি উপলক্ষ্যে অনেক বড় পরিসরে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়৷ বোমাটি যখন নিক্ষেপ করা হয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মানুষ, নিহতদের স্বজন, সাধারণ নাগরিক, রাজনীতিবিদ – সবাই এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন৷ অনেকেই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের জন্য অঙ্গীকার করেন এদিন৷
ছবি: Kazuhiro Nogi/AFP/Getty Images
জীবিত শেষ সদস্য নিহত
যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর যে দলটি ঐ ‘অ্যাটম বোমা’ নিক্ষেপ করেছিল সেই দলের জীবিত শেষ সদস্য থিওডোর ভ্যানকির্ক ২০১৪ সালের ৩০শে জুলাই মারা যান৷ জর্জিয়া রাজ্যে অবসরপ্রাপ্তদের একটি আবাসে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি৷ ‘ডাচ’ নামে পরিচিত কির্ক বোমা নিক্ষেপকারী বিমান এনোলা গে-র নেভিগেটর ছিলেন৷ সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর৷