জার্মানির দক্ষিণে আল্পস পর্বতের উপর মেঘের কোলে এক গবেষণাকেন্দ্র৷ সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মূল্যবান গবেষণা চলছে৷ এমনকি বায়ুমণ্ডলের উচ্চতম স্তরের অবস্থাও জানা যাচ্ছে সেখান থেকে৷
বিজ্ঞাপন
আল্পস পর্বতে প্রায় ৩,০০০ মিটার উঁচু সুগস্পিৎসে জার্মানির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ৷ উপত্যকা থেকে ‘কেবল কার’-এ চেপে তার কাছাকাছি পৌঁছানো যায়৷
শৃঙ্গের ঠিক নীচে জার্মানির উচ্চতম গবেষণা কেন্দ্রটি অবস্থিত৷ নাম‘শ্নেফ্যার্নহাউস’৷ গবেষকদের ১০টি দল সারা বছর ধরে এখানে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে এবং সব ধরনের পরিবর্তন নথিভুক্ত করে৷ উচ্চতা ও দূষণ-মুক্ত বাতাসের কারণে এখান থেকে জলবায়ু পরিবর্তন অসাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়৷ বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, কীভাবে হিমবাহ গলে যাচ্ছে৷ যেমন বায়ুমণ্ডল বিজ্ঞানী প্রো. মিশায়েল বিটনার বলেন, ‘‘বিজ্ঞানীরা একত্র হয়ে ঠিক করলেন, তাঁরা তাঁদের সম্মিলিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর কাঠামো বিশ্লেষণ করবেন৷ বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকটি বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর জ্ঞান আমরা কাজে লাগাতে পারি৷’’
আল্পস ভ্রমণ – অতীত এবং বর্তমান
এ বছর গ্রীষ্মে একদল পর্যটক সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতচূড়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন৷ ১৮৬৩ সালে প্রথম পর্বতারোহীরা যে পথ ধরে আল্পস-এ গিয়েছিলেন, সেই পথ ধরেই গিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
পূর্বসূরিদের পথ ধরে
১৮৬৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো একটি পর্যটন সংস্থা সুইজারল্যান্ডের আল্পস-এ একটি ভ্রমণের আয়োজন করেছিল৷ এ বছরের সুইস গ্র্যান্ড ট্যুর ২০১৩-তে একটি দল সেই সময়ের পথ ধরেই আল্পস ভ্রমণ করল৷ লিউকারবাড এবং কান্ডেরস্টেগের মধ্যকার গেমি পাস-এ দলটির অনেকে পর্বতারোহণও করেছে৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
নোট নেয়া
সে সময়কার একজন পর্যটক মিস জেমিমা মোরেল ঐ ভ্রমণের পুরো বর্ণনা একটি ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন৷ সেই ডায়রির বর্ণনা নতুন দলটিকে সাহায্য করেছে পথ বেছে নিতে৷ জেমিমা সেসময় ইংল্যান্ডের অনেক স্থান ভ্রমণ করলেও বিদেশে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম ভ্রমণ৷
ছবি: Thomas Cook
সঠিক পোশাকে পর্বতারোহণ
১৮৬৩ সালের ২৬শে জুন ‘জুনিয়র ইউনাইটেড আল্পাইন ক্লাব’ লন্ডন ব্রিজ থেকে তাদের তিন সপ্তাহের যাত্রা শুরু করেছিল৷ এই ছবিতে বাম দিক থেকে তৃতীয় নারীটিই জেমিমা৷ জেমিমা মোরেলসহ তখনকার নারীরা ভিক্টোরিয়া-যুগের পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন এবং তাঁদের হাতে থাকত একটি করে ছাতা৷
ছবি: Thomas Cook
আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা
১৮৬৩ সালের ঐ ভ্রমণের মাধ্যমে আধুনিক পর্যটন ব্যবসা শুরু হয় বলে অনেকের ধারণা৷ ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের থমাস কুক ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে তাঁর পর্যটন সংস্থাটি প্রথম চালু করেন৷ সুইজারল্যান্ড পর্যটন কোম্পানিগুলো তখন কুকের সাথে ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী হয়৷ তিনি ব্যবসার চেয়ে আগ্রহী ছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিচিত করতে৷
ছবি: Thomas Cook
ভ্রমণের টিকেট
১৮৬৩ সালের আগেও কিছু পর্যটন সংস্থা ছিল, কিন্তু কুক তাঁর ভ্রমণে এমন কিছু বিষয় জুড়ে দিলেন, যাতে তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল৷ যেমন রেল, বাস কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাঁর কোম্পানির সাথে যুক্ত করা৷ বিদেশের হোটেল বুকিং-এমন অনেক কিছু যুক্ত করেছিলেন কুক, যা পর্যটন ব্যবসায় একেবারেই নতুন ছিল৷
ছবি: Thomas Cook
গাইডস এবং ট্রাভেলারস চেক
এখানে যেমন দেখা যাচ্ছে – এ ধরনের ভ্রমণ বই দিয়ে প্রথমদিকে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করেছিলেন কুক৷ সেখানে থাকত ট্রেনের টাইমটেবিল৷ সেইসাথে তিনি ট্রাভেলারস চেকও আবিষ্কার করেছিলেন৷
ছবি: Thomas Cook
দরিদ্র কিন্তু সুন্দর
১৮৬০ সালে সুইরজারল্যান্ডের অবস্থা আজকের মতো এত ভালো ছিল না৷ অর্থাৎ, অর্থনীতির দিক দিয়ে দেশটি ছিল দরিদ্র৷ মোরেল তাঁর ডাইরিতে সুইজারল্যান্ডের গ্রামগুলোর তখনকার চিত্র তুলে ধরেছেন৷ কিন্তু কুকের পর্যটন সংস্থা সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে, বিশেষ করে সুইস আল্পসকে৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
আল্পসের স্বর্ণযুগ
সুইজারল্যান্ডে কুকের পর্যটন ব্যবসা সেদেশে পর্বতারোহণকে জনপ্রিয় করে তোলে৷ এ কারণে সেই সময়টাকে আল্পসে পর্বাতারোহণের স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ অনেক ব্রিটিশ পর্বতারোহী সুইস আল্পসে প্রথমবারের মতো আরোহন করেছিলেন৷ এডওয়ার্ড উইম্পার তাঁদেরই একজন, যিনি আল্পস পর্বত চূড়ায় প্রথম উঠেছিলেন ১৮৬৫ সালে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্রের মাধ্যমে গবেষকরা আল্পস পর্বতের বাতাসে ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রা মাপেন৷ শুধু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নয়, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণও মাপা হয়৷ কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত সারের মধ্যে এটি পাওয়া যায়৷ মানুষের কার্যকলাপের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ যে বেড়ে চলেছে, পরিমাপের সময় তা ধরা পড়েছে৷
বিশেষ লেজারের সাহায্যে গবেষকরা এমনকি গবেষণাকেন্দ্র থেকে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশের সীমান্তের তাপমাত্রাও মাপতে পারেন৷ সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ বায়ুমণ্ডল বিজ্ঞানী প্রো. মিশায়েল বিটনার বলেন, ‘‘সে কারণে আমরা বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে পরীক্ষা চালাচ্ছি৷ কারণ আমাদের মতে, সেখানকার তাপমাত্রায় ভূ-পৃষ্ঠের তুলনায় অনেক বেশি পরিবর্তন হতে চলেছে – এক থেকে দুই গুণ পর্যন্ত৷’’
সকালে বিজ্ঞানীরা নতুন যন্ত্র বসাচ্ছেন৷ এই মেঘ গবেষকরা মেঘের রহস্য সমাধান করতে চান৷ তাঁদের পরিমাপ যন্ত্রে মেঘে প্রতিফলিত আলো ধরা পড়ে৷ তার রংয়ের স্পেকট্রাম আবহাওয়াবিদদের বৃষ্টি ও তুষারের উৎস সম্পর্কে মূল্যবান ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ মেঘের মাঝে অথবা তারও উপরে অবস্থান হওয়ায় এই গবেষণাকেন্দ্রের উচ্চতা একেবারে আদর্শ৷
আজকের পরিমাপের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ জার্মানির এক গবেষণা বিমানে সেগুলি বসানো হবে৷ সেটি গোটা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে৷
যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা
প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রেখেছে নাসা৷ পরে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে এখন আকাশ থেকে সেই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে তারা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
অপারেশন আইসব্রিজ
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ক্রিয়োস্ফিয়ার কর্মসূচির অন্তর্গত ‘অপারেশন আইসব্রিজ’-এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে আকাশ থেকে মেরু অঞ্চলের উপর নজর রাখা হচ্ছে৷ ১৯৬৬ সালের লকহিড পি-৩ বিমান থেকে রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যেমে ঐ অঞ্চলের বরফের পুরুত্ব ও স্থান পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রস্তুতি চলছে
অপারেশন আইসব্রিজের মেয়াদ ছয় বছর৷ এর আওতায় মার্চ থেকে মে-তে গ্রিনল্যান্ডে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে অ্যান্টার্কটিকায় আট ঘণ্টা করে কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে বরফের পাত ও খণ্ডের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিমানে আছে উচ্চ প্রযুক্তি
উপর থেকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ক্যানাডার এলেসমেয়ার দ্বীপের গ্লেসিয়ার দেখতে পাচ্ছেন৷ অপারেশন আইসব্রিজে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ ‘আইস-পেনিট্রেটিং রাডার’ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিমান নীচু দিয়ে উড়ে গেলে রাডারটি ভালো কাজ করে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রভাব এখনই দেখা যাচ্ছে
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখনই দেখতে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷ উপরের ছবিতেও সেটি বোঝা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিকল্প ব্যবস্থা
অপারেশন আইসব্রিজ আসলে নাসার একটি বিকল্প ব্যবস্থা৷ কারণ ২০০৩ সালে একই কাজের জন্য ‘আইসস্যাট’ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ চালু করেছিল তারা৷ কিন্তু ২০০৯ সালে সেটি হঠাৎ করে তথ্য সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেয়৷ ফলে ‘আইসস্যাট-দুই’ নামে আরেকটি উপগ্রহ তৈরির কাজ শুরু করেছে নাসা, যেটি আগামী বছর চালু হওয়ার কথা৷ ২০০৯ থেকে ২০১৮ – এই নয় বছরের তথ্যও যেন সংগ্রহে থাকে সেজন্য অপারেশন আইসব্রিজ শুরু করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
সীমাবদ্ধতা
আইসস্যাট-এর মাধ্যমে সারা বছর ধরে অনেক বিস্তৃত এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল৷ কিন্তু অপারেশন আইসব্রিজের সাহায্যে শুধু মেরু অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে এবং সেটিও মাত্র কয়েক মাসের জন্য৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
‘আইসস্যাট-দুই’ নিয়ে অনিশ্চয়তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাসার আর্থ সায়েন্স প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় আগামী বছর এই কৃত্রিম উপগ্রহের কাজ শুরুর বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়েছে৷