পাহাড়িরা ভূমির অধিকার কবে পাবে?
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭রয়টার্স-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারপাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে মানতে নারাজ৷ সরকার মনে করে, দেশে কোনও আদিবাসী নেই৷ কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ওই এলাকাকে একটি সুরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল৷ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিশেষ বিধানগুলো লঘু বা দুর্বল হয়ে পড়ে৷ সশস্ত্র সংঘাতের পর, বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি করে৷ ওই চুক্তিতে পাহাড়ি জনগণের ভূমির অধিকার, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়৷
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে৷ এই সীমান্তের ব্যাপ্তি ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি৷ এ এলাকায় এক ডজনেরও বেশি আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ লাখ পাহাড়ির বসবাস৷
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এ অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ৷ বিশেষ করে এখানকার কাঠ এবং বাঁশের কথা উল্লেখযোগ্য৷ এ এলাকায় তেল অনুসন্ধানের সম্ভাবনাগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে৷ তবে এখানে গত কয়েক দশক ধরেই সহিংস জাতিগত সংঘাত পরিলক্ষিত হয়েছে৷ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো মানুষ৷ তাদের ফেলে যাওয়া ভূমির দখল নিয়েছে বাঙালি সেটেলাররা৷
সরকার পাহাড়িদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ এছাড়া তাদের নিজস্ব প্রথা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতিও দেয়া হয়৷
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুনের গোড়ার দিকে রাঙ্গামাটির মানিকজোড় ছড়া গ্রামে যখন আগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, সে সময় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন রিপন চাকমা'র অশীতিপর মা-বাবা৷ রিপন চাকমা'র মা-বাবা বেঁচে গেলেও গুনামালা চাকমা নামের এক বয়স্ক প্রতিবেশী মারা যান৷ কাদামাটির তৈরি ঘরে তাঁকে জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে৷
পুলিশ বলছে, রাঙ্গামাটির লংগদুতে বাঙ্গালি সেটেলাররা আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দুই শতাধিক ঘরবাড়ি এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করেছে৷ চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে এখানেই সর্বোচ্চ সংখ্যক জাতিগত সংখ্যালঘুর বসবাস৷
প্রতিবেশী জেলা খাগড়াছড়ি সংলগ্ন দিঘীনালা রোডের কাছে এক বাঙ্গালির মরদেহ পাওয়ার পর এ হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ হত্যাকাণ্ডের জন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে অভিযুক্ত করেনবাঙ্গালি সেটেলাররা৷ তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাহাড়িরা৷ তাঁরা বলছেন, অগ্নিসংযোগ ছিল পূর্বপরিকল্পিত৷ তাঁদের পাহাড় থেকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছে৷
স্থানীয় বেসকারি সংস্থা ‘তৃণমূল'-এর নির্বাহী পরিচালক রিপন চাকমা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘সবই সাজানো নাটক৷ ভূমি দখলের জন্যই এসব করা হচ্ছে৷ অন্যথ্যায় কেন তারা দীঘিনালার একটি মৃত্যুর জন্য লংগদুতে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে?''
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড়ে আর সমতলে যেখানেই হোক না কেন, আদিবাসীদের ওপর হামলার মূল কারণ তাঁদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা৷ হামলার পাশাপাশি হুমকি এবং নারী নির্যাতনও করা হয়৷''
এদিকে লংগদুর তিনটিলা গ্রামের সহকারী শিক্ষক চন্দ্র সুরথ চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগুন দেয়ার পর আমরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও বনে জঙ্গলে ছিলাম৷ সরকারের সহায়তা বলতে পেয়েছি দুই বান ঢেউ টিন, ৩০ কেজি চাল ও দু'টি কম্বল৷ আমাদের নতুন করে ঘর বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রতি সরকার দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি৷ পুড়ে যাওয় টিন এবং নতুন কিছু টিন দিয়ে কোনোভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছি৷ কিন্তু বৃষ্টিতে এই ছাউনি আমাদেরর রক্ষা করতে পারে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি ১৯৯২ সালে শিক্ষকতা শুরু করি৷ সেই থেকে অল্প অল্প করে সংসারে অনেক কিছুই তৈরি করেছি৷ আমার ঘরে অনেক কিছুই ছিল৷ আগুনে নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেল৷ চিন্তাও করিনি এমন হবে৷ আমার তো তবু মাসের শেষে কিছু বেতন আছে, তা দিয়ে চলি, অনেকের তো কিছুই নাই৷''
বাইট্টাপাড়া গ্রামের অরেক ক্ষতিগ্রস্থ বুদ্ধ জয় চাকমা বলেন, ‘‘পাশের গ্রামে এখনও আছি৷ পরের ঘরে থাকা কী যে কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না৷ কিন্তু আমরা নিরুপায় হয়ে আছি৷ আর নতুন করে ঘর বানানোর মতো টাকাও হাতে নাই৷ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি৷ সরকার ঘর করে দিলে ঘর হবে, না দিলে রাস্তায় রাস্তায় থাকতে হবে৷ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এসব মানুষের দাঁড়ানো সম্ভব না৷ আগে আমাদের সবার মধ্যে যে সম্প্রীতি ছিল, তা একদিনে নষ্ট হয়ে গেল৷''
গত ১ জুন লংগদু উপজেলার সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ দীঘিনালার চারমাইল এলাকায় পাওয়া যায়৷ স্থানীয় বাঙালিরা এই ঘটনার জন্য পাহাড়ের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দায়ী করে৷ এ ঘটনার প্রতিবাদে ২ জুন সকালে নয়নের লাশ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়৷ মিছিল উপজেলা সদরে আসার পথে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়৷ লংগদু উপজেলা সদরসহ তিনটিলা, বাইট্টাপাড়া, মানিকজোড় ছড়া গ্রামের পাহাড়িদের প্রায় তিন শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়৷ এরপর থেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ এলাকার লোকজন৷
লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাদ্দেক মেহ্দী ইমাম বলেন, ‘‘আমরা এখনো তাদের বাড়ি তৈরি করে দিতে পারিনি৷ তবে আমরা নকশা করে পাঠিয়েছি, নকশা অনুমোদন হলেই কাজ শুরু করা যাবে৷ খুব তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারে৷''
রাঙামাটির লংগদুতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ২১২টি পরিবারকে জেলা প্রশাসন থেকে ছয় হাজার করে টাকা, ২ বান্ডেল টিন, ৩০ কেজি চাল ও দু'টি করে কম্বল দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানয়৷ এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন-২ প্রকল্প থেকে পরিবার প্রতি ৫ লাখ টাকা করে মোট ১১ কোটি টাকা দেওয়ার কথাও বলা হয় ৷