বান্দরবানে ছয় জনকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সংস্কারপন্থিদের জেলা সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িতে গুলি করে হত্যার করা হয়৷ হামলায় রতন তঞ্চঙ্গ্যাও নিহত হয়েছেন৷ স্থানীয়রা মনে করেন এটা পরিকল্পিত হত্যা৷
বিজ্ঞাপন
হামলার জন্য মূল জেএসএস-এর সদস্যদের দায়ী করা হচেছ৷ জানা গেছে, বান্দরবানের রাজবিলার বাঘমারা এলাকায় রতন তঞ্চঙ্গ্যার বাড়ি৷ ওই বাড়িতে সকালে তাদের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই খেতে যেতেন, দলীয় বৈঠক করতেন৷ ওই সময় তারা নিয়মিত জড়ো হন জেনেই প্রতিপক্ষ মঙ্গলবার সকাল ৭টার কিছু পরে হামলা চালায়৷
‘মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে’
সংস্কারপন্থিদের কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর বড়ুয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করেছেন, বান্দরবানের বোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামে রতন তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িতে এই হামলা হয়৷ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন এক দল সন্ত্রাসী সকাল সোয়া ৭টার দিকে হামলা চালায়৷ হামলায় ছয়জন নিহত এবং তিনজন আহত হন৷ নিহতরা হলেন, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বিমল কান্তি চাকমা (প্রজিং), উপদেষ্টা কমিটির সদস্য চিংথোয়াইয়াঅং মারমা (ডেভিড), বান্দরবান জেলা সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির সভাপতি রবীন্দ্র চাকমা, যুব সমিতির সদস্য রিপন ত্রিপুরা ও জ্ঞান ত্রিপুরা৷ জেলা পুলিশ সুপার জেরিন আখতারও ছয় জন নিহত এবং তিন জন আহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন৷
পাশের রাজবিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্যা অং প্রু মারমা বলেন,‘‘হামলাকারীরা ওই বাড়ির পেছনের একটি বিল (মাঠ) দিয়ে হেঁটে আসে এবং হামলার পর আবার হেঁটেই চলে যায়৷ রতন তঞ্চঙ্গ্যা দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রে বাঘমারা গ্রামে প্রায়ই অবস্থান করতেন৷ সেই সময় তার দলের নেতা-কর্মীরাও আসতেন৷ এটা তাদের একটি আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো৷’’
‘চাঁদা আদায়ের জন্যই তাদের এই আধিপত্যের লড়াই’
ধারণা করা হচ্ছে, নিয়মিত অবস্থানকে অনুসরণ করেই প্রতিপক্ষ হামলাটি চালায়৷ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ হয়েছে বলেও কোনো তথ্য নেই৷ সংস্কারপন্থিদের সবাই নিরস্ত্র ছিলেন বলে তিনি জানান৷ দুই-একজন পালাতে চেষ্টা করেও পারেননি৷
পুলিশ ঘটনাস্থলে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র পায়নি, তবে বেশ কিছু গুলির খোসা উদ্ধার করেছে৷ তাই হামলাকারীদের প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা বা পাল্টা হামলা হয়েছে বলে তারা মনে করে না৷ পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে৷ হামলার কারণ তদন্ত করে জানা যাবে৷ তবে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়৷’’
রতন তঞ্চঙ্গ্যার এই বাড়িতে দেড় মাস আগেও একবার হামলা হয়েছিল বলে পুলিশ জানায়৷ তবে তখন হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম: শাসন ও সংঘাতের ইতিহাস
পাহাড় আর সবুজ ঘেরা বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দর এক অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ কিন্তু সেখানকার ভূমি নিয়ে যুগ যুগ ধরে চলেছে দখলের লড়াই৷ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অবলম্বনে ছবিঘরে থাকছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই ইতিহাস৷
ছবি: DW/M. Mamun
আরাকান ও ত্রিপুরা রাজের লড়াই
৯৫৩ সালে এখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার দখলে৷ তিনশ বছরের শাসনের পর ১২৫৩ সালে তাদের কাছ থেকে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা অঞ্চলটি দখল করে নেয়৷ ১৫৭৫ সালে আবার দখল ফিরে পায় আরাকানরা৷ ১৬৬৬ সালে তাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নেয় মুঘলরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ব্রিটিশ শাসন
১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ভারতের অধীনে আসে অঞ্চলটি৷ প্রশাসনিকভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বঙ্গ প্রদেশের অধীনে আনে৷ শাসনের জন্য ১৯০০ সালে ‘চিটাগং হিল ট্র্যাকস রেগুলেশন অ্যাক্ট’ নামের আইন প্রবর্তন করে৷ ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
১৯৫৬ সালে পাহাড়ি ছাত্ররা নিজেদের দাবি আদায়ে হিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে৷ ১৯৬৬ সালের গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি, যার নেতৃত্বে ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা ও জে বি লারমা৷ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ সমিতির সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন৷
ছবি: DW/M. Mamun
চার দফা দাবি
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা৷ দাবিগুলো ছিল: পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন, সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের মতো সংবিধির অন্তর্ভুক্তি, সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রত্যাখ্যান ও অসন্তোষ
পাহাড়ীদের দাবি অনুযায়ী পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতির পরিবর্তে সংবিধানে সবাইকে বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ পাশাপাশি চার দফা দাবিও মেনে নেয়নি সরকার৷ এর ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ৷ নিজেদের অধিকার রক্ষায় ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, তাদের সামরিক সংগঠন ছিল শান্তিবাহিনী৷
ছবি: DW/M. Mamun
অন্তর্কোন্দল
শুরু থেকেই দুটি মতাদর্শে ভাগ হয়ে যায় জনসংহতি সমিতি৷ মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে ছিল বামপন্থি লারমা গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বে ছিল জাতীয়তাবাদী প্রীতি গ্রুপ৷ ১৯৮৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হামলায় নিহত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা৷ তাঁর ছোট ভাই জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) দলের নেতৃত্বে আসেন৷ ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে প্রীতি গ্রুপের ২৩৬ জন সদস্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন৷
ছবি: bdnews24.com
সামরিক শাসন
পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধের কারণে সৃষ্ট বন্যায় সেখানকার প্রায় একলাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন৷ নিজেদের ভূমি ফিরে না পাওয়ায় অসন্তোষ ছিল পাহাড়িদের মধ্যে৷ তার উপর ১৯৭৯ সালে গোষ্ঠী মালিকানাধীন জমিকে খাস জমি ঘোষণা করে সেখানে বাঙালি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম নেয় সরকার৷ উচ্ছেদ হয় বহু পাহাড়ি পরিবার৷ ১৯৯১ সালে বাঙালিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৪৮.৫ শতাংশে, যা ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ১১.৬ শতাংশ৷
ছবি: bdnews24.com
সংঘাত
আশির দশকে শান্তি বাহিনী সামরিক দিক থেকে সংগঠিত হতে শুরু করে৷ ১৯৭৭ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বহরের উপর হামলা চালায়৷ এরপর সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে আনে৷ পাল্টা হামলা শুরু করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শান্তি চুক্তি
১৯৯৭ সালের দুই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়৷ চুক্তির আওতায় তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়৷ বলা হয়েছে, উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার নির্ধারিত হলে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ এ উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমির উপর মালিকানা নির্ধারণের জন্য ভূমি জরিপব্যবস্থা পরিচালিত হবে৷
ছবি: bdnews24.com
শান্তি ফেরেনি
শান্তি চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরেনি৷ অভিযোগ আছে এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন আজও হয়নি৷ ইতি ঘটেনি সংঘাত ও অশান্তিরও৷ কল্পনা কিংবা মাইকেল চাকমার মতো রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গুম, হত্যার অভিযোগ আছে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে৷ নিজেদের বিভিন্ন দলের অন্তর্কোন্দলেও প্রতিনিয়ত প্রাণ ঝরছে পাহাড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
পাহাড়ে চার প্রুপ
পাহাড়ে এখন চারটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপ সক্রিয়৷ শান্তি চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুতে ২০১০ সালে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামের আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে৷ এমএন লারমার অংশই জেএসএস সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত৷ এখন এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুধা সিন্ধু খীসা৷
অন্যদিকে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দাবিতে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুই ভাগ হয়ে যায়৷ নতুন অংশ ইউপিডিএফ-গণতন্ত্র নামে পরিচিতি পায়৷ তারা পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে কিছুটা সরে এসে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে৷
সংঘাত-সংঘর্ষ
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৮ ও ২০১৯ সালেই পাহাড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলের মধ্যে সংঘর্ষে ৮২ জন নিহত হয়েছেন৷ আর গত ৬ মাসে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫ জন৷ ক্যা অং প্রু মারমা বলেন, ‘‘পাহাড়ে এই গ্রুপগুলো আধিপত্য বজায় রাখতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ চাঁদা আদায়ের জন্যই তাদের এই আধিপত্যের লড়াই৷ পাহাড়ি, বাঙালি সবাইকেই চাঁদা দিতে হয়৷ তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে লাশ ফেলে দেয়া হয়৷’’
শান্তি চুক্তির পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ পুলিশ সুপার বলেন,‘‘ তাদের নানা গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷ আমরা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি৷’’