1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাহাড়ে শান্তি: চুক্তিতে অনেক, বাস্তবে কম

১৪ এপ্রিল ২০২৩

শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পার হয়ে গেলেও পাহাড়ে শান্তি আসেনি৷ সাম্প্রতিক সময়ে আবার বেড়েছে হানাহানি৷ পাহাড়ে অন্তত পাঁচটি সশস্ত্র গ্রুপ নানা সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে৷

জনপদে সাধারণ অপরাধ থাকে; কিন্তু পাহাড়ে যা হচ্ছে তা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়
জনপদে সাধারণ অপরাধ থাকে; কিন্তু পাহাড়ে যা হচ্ছে তা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়ছবি: DW/M. Mamun

বিশ্লেষক ও পাহাড়ের নেতারা বলছেন, এর মূল কারণ শান্তিচুক্তিরমূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া৷ এতে পাহাড়িদের মধ্যে অবিশ্বাস, হতাশা আর দ্বন্দ্ব বাড়ছে৷ একটি জনপদে সাধারণ অপরাধ থাকে; কিন্তু পাহাড়ে যা হচ্ছে তা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়৷

গত ৭ এপ্রিল বান্দরবানের বোয়াংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে আট যুবকের লাশ উদ্ধার করে৷ তারা সবাই বম জনগোষ্ঠীর৷ পুলিশ দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছে বলে দাবি করলেও ওই দুইটি গ্রুপের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ পাহাড়ে একসঙ্গে এতজনকে হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আর ঘটেনি৷

এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মে আধিপত্যের কোন্দলে ব্রাশফায়ার করে জনসংহতি সমিতি, সংস্কার(জেএসএস)  সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করা হয়৷ অভিযোগের তির ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ইউপিডিএফের সদস্যদের দিকে৷ পরদিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ‘ব্রাশফায়ার' করে হত্যা করা হয়৷ ইউপিডিএফ (মূল)-এর সশস্ত্র গ্রুপ এই কাজ করেছে বলে অভিযোগ৷ ওই বছরের ২ মে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল কান্তি চাকমাকে জেএসএস (সংস্কার)-এর সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ৷ কয়েকদিন পর ২৮ মে সাজেক থানার করল্লাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফ (মূল)-এর সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন৷

পাহাড়ে এই সন্ত্রাস ধারাবাহিকভাবেই কম-বেশি চলে আসছে৷ হালে কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরো একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান ঘটেছে৷ সর্বশেষ আট জনকে হত্যার জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে৷ পাহাড়ে মোট পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই সব সময়েই চলে৷
পাহাড়ের নেতারা মনে করেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশাআর অবিশ্বাস থেকেই এই গ্রুপগুলোর জন্ম হয়েছে৷ তারা নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়ছে৷ আধিপত্যের লড়াইয়ের পিছনে আছে চাঁদাবাজি৷ কারণ, গ্রুপ চালাতে অর্থ লাগে৷

''চুক্তির মৌলিক বিষয়ের ৫টি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি''

This browser does not support the audio element.

তারা বলছেন, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মূল বিষয় ছিল পাহাড়ি জনগণের ভূমির অধিকার, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার৷ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৭২টি বিষয়ের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে৷ কিন্তু পাহাড়ের নেতাদের দাবি , ৭২টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র ২৫টির বাস্তবায়ন হয়েছে৷

চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, চুক্তির মৌলিক বিষয়ের ৫টি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি৷ এগুলো হলো-
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বেসামরিকীকরণ করা ৷
২. শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ৷
৩. আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে যথাযথভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ৷
৪. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমি সংস্কার করা ৷
৫. সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম যে একটি অদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা সেরকম কোনো ঘোষণা বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া৷

জনসংহতি সমিতির দাবি, বিগত দুই যুগেরও বেশি সময়ে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের দুই তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের ভূমি ফেরত পায়নি৷ তাদের ৪০টি গ্রাম, ভিটে-মাটি ও জায়গা-জমি এখনো সেটলার বাঙালিদের পুরো দখলে রয়েছে৷ নিজ জায়গা-জমি ফেরত না পাওয়ায় জুম্ম জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন যাপন করছে৷

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, " পাহাড়ে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে এগুলো হচ্ছে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফল৷ শান্তি চুক্তি-বিরোধী অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু যেসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তারা কোনো বিচার হচ্ছে না৷ আর কোনো গ্রুপ ইন্ধনে তৈরি হয়েছে৷ কোনো মহলের স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে৷”

তার কথা, ‘‘আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে৷ পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, ভূমি সংস্কার বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদ হওয়ার কথা হয়েছে৷ এগুলোর নেতৃত্বে আদিবাসীরা আছেন৷ কিন্তু আইন ও বিধি প্রণয়ন কি হয়েছে? হয় নাই৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তারা পায়নি৷ মূল কথা হলো, অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা দরকার, তা হয়নি৷ ভূমি সংস্কার না করে কৌশলে আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তর করা হচ্ছে৷''

জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও রাঙামাটির স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, " পাহাড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তো থাকবে৷ একটা কমিউনিটি তো সব সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না৷ মতভিন্নতা থাকতে পারে৷ দ্বিধা, সংশয়, অবিশ্বাস থেকে এগুলো হয়৷ কৃত্রিম ভাবেও সংকট তৈরি করা হয়৷ আর এর কারণে হানাহানি, সংঘাত হয়৷ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হলে এগুলো থেমে যাবে৷”

তিনি বলেন, "ভূমি কমিশন হলেও বিধি হয়নি৷ ফলে ভূমি কমিশন কাজ করতে পারছে না৷ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা এখনো পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে দেয়া হয়নি৷ ফলে এর দায় কে নেবে? সেখানে সমস্যা আছে বলেই তো শান্তি চুক্তি হয়েছে৷ সেটা বাস্তবায়ন না হলে তো শান্তি আসবে না৷”

''পাহাড়ে গোষ্ঠীদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকতে পারে''

This browser does not support the audio element.

সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা বলা হয়েছে মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ বা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত তার ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ' শিরোনামের এক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা ৪৭ শতাংশ৷ গত তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত, আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে৷''

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার উন্নয়নে দুই হাজার ৮১৪টি সেট কমিউনিটি সোলার সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে৷ আর হোম সোলার প্যানেল বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার৷ গত বছরের ৭ নভেম্বর পার্বত্য এলাকার জন্য ৪২ টি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে৷ আর আগে থেকেই ওই তিন জেলার উন্নয়নে অনেক কাজ করা হয়েছে৷ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে৷ গত অর্থ বছরে পার্বত্য তিন জেলায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬৯টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়৷ ওই এলাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হয়েছে৷

আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি সংদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, "পাহাড়ে মূল সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা৷ তাদের কমিশনকে কাজ করতে দিতে হবে৷ আর পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে৷ সমতলের আদিবাসীদের জন্যও একটি ভূমি কমিশন গঠন করা দরকার৷”

পাহাড়ের এই সার্বিক সংকট নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি দবিরুল ইসলাম বলেন, "আমি সমতলের মানুষ, পাহাড়ের সংকট বুঝি না৷ অযথাই আমাকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে৷ তবে পাহাড়ে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে তা বন্ধ করা প্রয়োজন৷ হতে পারে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সংকট কেটে যাবে৷ তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেননি৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ