সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে, বাবা, অথবা মা, যে কোনও একজনের পরিচয়ই গ্রহণযোগ্য৷ এই স্বীকৃতি আইনের৷ তবু নানাবিধ জটিলতায় দীর্ণ সমাজ৷
বিজ্ঞাপন
শহর কলকাতায় সাম্প্রতিক আলোড়ন ফেলা খবর, কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে মেয়রের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের রাতভর ধরনা৷ শেষে মেয়রের অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় থানার পুলিশ এসে রত্না চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করার পর নাটকের যবনিকা পড়ে৷ কিন্তু পরবর্তীতে যে সমস্যার কথা জানা যায়, তা বেদনাদায়ক৷ দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সমস্যার জেরে শোভন এবং রত্না চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে এবং আপাতত সেই বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া চলছে৷ কিন্তু ওঁদের দু'জনের কন্যা, যে কলকাতার এক নামী বেসরকারি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে, এক ছাত্র-ছাত্রী বিনিময় কর্মসূচির আওতায় তার জার্মানি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল৷ কিন্তু শেঙেন ভিসা চাওয়ার যে আবেদনপত্র, তাতে বাবা এবং মা, দু'জনের স্বাক্ষরই প্রয়োজন৷ কিন্তু সই করতে রাজি নন মেয়র, কারণ, তাতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে৷
ভালোবাসার সম্পর্কে ‘বিশ্বাস’ কি হারিয়ে যাচ্ছে?
পরকীয়া প্রেম নতুন বিষয় নয়৷ কিন্তু দাম্পত্য জীবনে যদি মিথ্যা আর প্রতারণা ঢুকে সংসার বা সমাজে সমস্যা তৈরি করে, তবে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত৷ এ কথা মনে করেন জার্মানির পরিবার ও জীবনসঙ্গী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: Fotolia/Rido
পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ার কারণ
বিবাহিত নারী বা পুরুষের কাউকে ভালো লাগতে পারে বা তাঁরা কারও প্রেমেও পড়তে পারেন৷ বিয়ের পর প্রেমে পড়া এবং ভালোলাগার মানুষটির সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করাই পরকীয়া৷ সাধারণত ধরে নেয়া হয়, তাঁরাই এই সম্পর্ক তৈরি করে যাঁরা দাম্পত্য জীবনে পুরোপুরি সুখি নয় বা যাঁদের সম্পর্কে সমস্যা রয়েছে৷ তবে এর ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে!
ছবি: picture-alliance/dpa
কে দায়ী?
দাম্পত্য জীবনে অশান্তির একটি বড় কারণ হচ্ছে পরকীয়া প্রেম৷ এ কারণে বহু সংসার ভেঙে যায়৷ তবে এ ব্যাপারে নারী বা পুরুষ, কে দায়ী তা বলা মুসকিল৷ একজন পার্টনার পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে গেলে, অন্যজন তাঁর প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও অনেক সময় নিজেকে অন্য আরেকজনের সাথে জড়িয়ে ফেলেন৷
ছবি: AP
সহকর্মীর সাথে পরকীয়া প্রেম
দিনের বেশিরভাগ সময়ই মানুষ কর্মস্থলে কাটায়৷ সে কারণে নিজের নানা সমস্যার কথা অনেকেই সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করে থাকেন৷ এ সবের মধ্য দিয়ে প্রথমে সহানুভূতি এবং পরে পরকীয়া প্রেমের জন্ম হতে পারে৷ জার্মানিতে এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে৷
ছবি: Imago/Westend61/zerocreatives
অফিসিয়াল ট্যুর
কোনো কোনো সহকর্মীর মধ্যেই হালকা সম্পর্ক থাকলে অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়ে সে সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ এ ধরনের ঘটনা কিন্তু আপাত সুখি দম্পতিদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে৷ অনেকের ক্ষেত্রে পরে চাইলেও সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্ষমা করা কি সম্ভব?
১০-১৫ বছর সংসার করার পর যখন কেউ পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে যান, তখন স্ত্রী বা স্বামী তা জেনে গেলে তাঁরা ক্ষমা চান এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবকিছু ভুলে গিয়ে আবারো আগের মতো হতে চান৷ অনেকে মুখে ক্ষমা করে দিলেও, দু’জনের ভেতরে সন্দেহটা কিন্তু থেকেই যায়৷
ছবি: Fotolia/Sascha Tiebel
ক্ষণিকের আনন্দ
বিবাহিত নারী বা পুরুষ হঠাৎ কোনো দূর্বল মুহূর্তে অন্য কারও সাথে রাত কাটানোর সুযোগ নিয়ে থাকেন৷ এ রকম ঘটনা পুরুষদের ক্ষেত্রেই নাকি বেশি ঘটে, বিশেষ করে স্ত্রীর প্রিয় বান্ধবীর সাথে৷ শুধুমাত্র এক রাতের ব্যাপার হলে অনেক স্ত্রীই কিন্তু স্বামীকে ক্ষমা করে দেন৷ জানান পরিবার ও জীবনসঙ্গী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এরিক হেগমান৷
ছবি: Fotolia/drubig-photo
যাঁদের ভোগান্তি
মা-বাবার পরকীয়া প্রেমে কষ্ট পায় আসলে সন্তানরা, বিশেষ করে তাদের বয়স যদি কম হয়৷ হঠাৎ করে মা-বাবার মধ্যকার সম্পর্ক বা অন্যরকম আচরণ শিশুদের আতঙ্কিত করে৷ শিশুমনে পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব, যা হয়ত সারাজীবন থেকে যায়৷
ছবি: goodluz - Fotolia
স্যোশাল মিডিয়া
আধুনিক বিশ্বে স্যোশাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও যে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ার একটা কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তবে জার্মানিতে কিন্তু পরকীয়া প্রেমে স্যোশাল মিডিয়ার ভূমিকা তেমন বড় নয়৷
কথা বলুন, কথা বলুন আর কথা বলুন
ভালোবাসার সম্পর্কে যখন চিড় ধরতে বা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে, তখনই নিজের অসন্তোষ বা ভালো ‘না’ লাগার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলুন৷ প্রয়োজনে শতবার৷ কারণ পরকীয়া প্রেমে যে শুধু একটি পরিবারই ভেঙে যায়, তা নয়৷ এতে সামাজিকভাবেও নানা জটিলতা দেখা দেয়৷ তাই খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ জার্মান বিশেষজ্ঞ এরিক হেগমানের৷
ছবি: picture-alliance/United Archives/Impress
9 ছবি1 | 9
এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই পুরনো বিতর্ক ফের খুঁচিয়ে তুলেছে যে, কেন আইনের নির্দেশ মেনে বাবা বা মা, কোনও একজনের সম্মতি, স্বাক্ষর যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না৷ সেই সূত্রে জানা গেছে, শুধু দম্পতিদের ক্ষেত্রে নয়, যে একা মা কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অর্থাৎ বাস্তবজীবনে যে সন্তানের বাবার কোনও অস্তিত্ব নেই, তাদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা বারবার হয়েছে৷ আজকের দিনে অনেক স্বাধীনচেতা মহিলা এইভাবে মা হচ্ছেন৷ তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং পেশার সূত্রেই নিয়মিত বিদেশ যান৷ তাঁদের সন্তানদের ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয় না থাকার এই সমস্যা বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী যেমন স্কলারশিপ পেয়ে অ্যামেরিকায় গিয়েছিলেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও নিজের নাবালিকা মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেননি, যেহেতু মেয়েটির বাবা, অর্থাৎ ওই নৃত্যশিল্পীর স্বামীর কোনও খোঁজ ছিল না৷
বিবাহ বিচ্ছেদের পর দু'জনেই যে যার পথে চলে যান এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ কিন্তু ভিসার আবেদনপত্রে সেই ভদ্রলোকের সম্মতিসূচক স্বাক্ষর জরুরি, যেহেতু নাবালিকা মেয়েটির পাসপোর্টে বাবা হিসেবে তাঁর নাম আছে৷
নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন চিত্রকর ঈলিনা বণিক
সমস্যা আসলে ওখানেই, জানালেন বিশিষ্ট চিত্রকর ঈলিনা বণিক, যিনি নিজে কৃত্রিম পদ্ধতিতে গর্ভসঞ্চার ঘটিয়ে এক কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া দীর্ঘ এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বোঝালেন, যেহেতু পাসপোর্টে পিতৃপরিচয় আছে, সেহেতু নিয়ম অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ক্ষেত্রে ভিসা ফর্মে বাবা-মা, দুজনেরই সই লাগবে৷ ঈলিনা নানাজনের অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বলেই শিশুকন্যার পাসপোর্টে কেবল মা হিসেবে নিজের নামই রেখেছিলেন, জৈবিক পিতার নাম সীমাবদ্ধ কেবল মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটে৷ এবং তিনি একাই যে মেয়ের অভিভাবক, এই মর্মে আদালতে একটি হলফনামাও দিয়েছিলেন ঈলিনা, যা জোরে তিনি বিভিন্ন জায়গায় একা মা হিসেবে কন্যার অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করেছেন৷ কিন্তু তার পরেও খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর, যা ঈলিনা অকপটে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলেকে৷ যেমন মেয়ের পাসপোর্ট করাতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে সবার সামনে হেঁকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে মেয়ের পিতৃপরিচয় কী কারণে নেই? যদিও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন ঈলিনা, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা এই পিতৃতান্ত্রিক, আগাগোড়া পুরুষশাসিত সমাজের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে৷
পিতৃপরিচয় কি সব? মায়ের পরিচয়ের কোনো দাম নেই? আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷
ছাড়াছাড়ি মা-বাবার, ভোগান্তি সন্তানের
প্রযুক্তির সুবিধা বাড়ার সাথে বাড়ছে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা৷ বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকার প্রবণতাও৷ বিশেষজ্ঞদের মতে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানের মনোজগতে৷ ওর স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Beck
শিশুদের ভয় আর আতঙ্ক
সন্তানের কাছে মা-বাবার ছাড়াছাড়ি মেনে নেয়া অনেক কষ্টকর৷ বিশেষ করে সন্তানের বয়স যদি কম থাকে৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হঠাৎ করে একজনের সাথে, অর্থাৎ মা বা বাবার সাথে থাকতে হয় বলে শতকরা ৩৭ থেকে ৪৮ ভাগ শিশু-কিশোরের মনেই অন্যজনকে হারানোর ভয় থাকে৷
ছবি: goodluz - Fotolia
যে কষ্ট তারা বোঝাতে পারে না
যে কোনো সন্তানের কাছে মা-বাবাই তার সবচেয়ে কাছের, ভালোবাসার মানুষ৷ আর তাদের মধ্যেই যখন বোঝাপড়া না হয়, তখন শিশুরা হয়ে পড়ে অসহায়৷ যা থেকে অনেক শিশু বা কিশোর-কিশোরী প্রচণ্ড আঘাত পায় আর সেই আঘাতের ক্ষত হয়তো তাকে সারা জীবনই কষ্ট দেয়৷ এমনটাই মনে করেন মিউনিখের মনোচিকিৎসক বেনেডিক্ট ক্লাউকে৷
ছবি: Fotolia/Kitty
‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না, আমি মূল্যহীন’
মা-বাবার ছাড়াছাড়ির মনোকষ্টের কথা শিশুরা সহজে বোঝাতে পারে না৷ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, পড়াশোনায় মনোযোগ না থাকা বা অকারণে হঠাৎ করে রেগে যাওয়া – এ সবের মধ্য দিয়েই শিশুদের কষ্টের প্রকাশ ঘটে৷ ওদের তখন মনে হয়, ‘‘আমার কেউ নেই৷ আমাকে কেউ ভালোবাসে না৷ আমি মূল্যহীন৷’’ ওরা ভাবে, ওদের যদি কেউ ভালোবাসে, তাহলে ভালোবাসার দু’জন মানুষের মধ্যে একজন তাকে ছেড়ে যাবে কেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা
ডিভোর্স বা ছাড়াছাড়ি যেমন মা-বাবার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি সন্তানের জন্যও৷ সমীক্ষায় জানা গেছে, পরিবারকে নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে মা এবং বাবাকেই বড় ভূমিকা নিতে হবে৷ সন্তানের সাথে কথা বলার জন্য যে কোনো পরিস্থিতেই পিতা-মাতাকে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ তাছাড়া সন্তানের কাছে একে অপরকে দোষারোপ করাও উচিত নয়, কারণ, এই জটিল ব্যাপারে বাবা বা মায়ের পক্ষ নিতে গিয়ে সন্তানকে যেন বিচারকের ভূমিকা না নিতে হয়৷
মা-বাবা যা করবেন
যেসব দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাঁদের প্রতি বেনেডিক্ট ক্লাউকের পরামর্শ, ‘‘সন্তান যার কাছেই থাকুক না কেন, ওকে এমন একটা অনুভূতি বা ধারণা দিন যেন ও মনে করে, আপনারা আলাদা থাকলেও ওকে দু’জনই সমান ভালোবাসেন, কারণ, শিশুর জন্য মানবিক সম্পর্কের জায়গাগুলো বেশ জটিল৷ তাই যতটা সম্ভব ওর সাথে সময় কাটান৷ ‘তোমাকে ভালোবাসি’ বলতে ভুলবেন না৷ জানিয়ে দিন, ওর যে কোনো সমস্যায় আপনারা ওর সাথে আছেন এবং থাকবেন৷’’