পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসির আদেশের ঘটনাকে অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ তাদের মতে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৫২ জনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটল৷
বিজ্ঞাপন
অবশ্য বাংলাদেশের আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়নি৷ তবে নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে৷
মঙ্গলবার বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত৷ এর প্রতিক্রিয়ায় লন্ডন ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার তো প্রতিষ্ঠিত হয়ইনি, বরং ১৫২ জনকে ফাঁসি দেয়ার ঘটনা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ফাঁসির রায়কে অবিচার উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি বিবৃতিতে বলেছে, ২০০৯ সালের ঐ ঘটনা অত্যন্ত বর্বর, নৃশংস এবং গুরুতর৷ বহু মানুষকে শুধু হত্যাই নয় বরং ঐ ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল৷ তাই অ্যামনেস্টি ঐ ঘটনায় জড়িতদের একটি স্বচ্ছ বিচার দাবি করে আসছিল৷ কিন্তু এই ঘটনার শাস্তি হিসেবে যদি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাহলে তা দুর্ভাগ্যেরই নামান্তর বলে মনে করে অ্যামনেস্টি৷ তাদের মতে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে কখনো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না৷
অ্যামনেস্টির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের উপ পরিচালক পলি ট্রাসকট বিবৃতিতে বলেন, ১৫২ জনকে ফাঁসির আদেশের মধ্য দিয়ে ১৫২ জনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটল৷
তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে প্রতিক্রিয়া জনিয়েছে৷ তারা শাস্তি হিসেবে মৃত্যৃদণ্ডের বিরোধী৷ তবে তিনি মনে করেন এই বিচারকাজ সম্পূর্ণ হয়নি৷ এই বিচারের মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডে মাঠ পর্যায়ের যারা জড়িত তাদের শাস্তি হলো৷ কিন্তু এর নেপথ্যে যারা আছেন তাদের বিচারতো দূরের কথা তাদের চিহ্নিতই করা হয়নি৷ সাধারণ ডাল-ভাত কর্মসূচির কারণে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা কোনোভাইে ঠিক নয়৷ এর পেছনে বড় কোনো অপশক্তি কাজ করেছে৷ তাদের তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা দরকার৷ তিনি বলেন সবচেয়ে ভাল হতো এই মামলায় তাদের আসামি করা৷ কিন্তু তা করা হয়নি৷ তবে এখনো তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ আছে৷ নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার না হলে এই বিচার পূর্ণাঙ্গ হবে না৷
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশররফ হোসেন কাজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই বিচারে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়নি৷ বিচার হয়েছে প্রকাশ্য আদালতে৷ আর সবাই সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন৷ সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ কেউ যদি দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার৷ তবে পিলখানার মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত মৃত্যুদণ্ডই তাদের উপযুক্ত শাস্তি৷
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান বলেন, এতবড় একটি নৃশংস ঘটনার বিচার ৪ বছরের মধ্যে শেষ হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে৷