উৎসবেও উজ্জ্বল রাজনীতি। উৎসবের মধ্যেও বিরোধী দলের বইয়ের স্টলে ভাঙচুর। সিপিএমের একাধিক নেতা, বুদ্ধিজীবী গ্রেপ্তার।
বিজ্ঞাপন
শারদোৎসবেও পিছু ছাড়ে না রাজনীতি। শারদোৎসবেও থাকে বিরোধী স্বর দমন করার চেষ্টার অভিযোগ। আর বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনাই প্রমাণ করে দেয়, প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো, শারদোৎসবের উজ্জ্বল আলোর নীচেও রয়েছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার চোরা স্রোত। না হলে বিরোধী বামেদের বইয়ের স্টল এবং তাতে একটি পোস্টার নিয়ে কি করে তুলকালাম হতে পারে কলকাতায়? তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিচালক কমলেশ্বর ভট্টাচার্য-সহ একগুচ্ছ সিপিএম নেতাকে।
ঘটনার সূত্রপাত সপ্তমীর দিন। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও প্রতাপাদিত্য রোডের মোড়ে সিপিএমের একটি বইয়ের স্টল ঘিরে। ওই স্টলে একটা পোস্টার ছিল, 'চোর ধরো, জেল ভরো'। ওই পোস্টার দেখেই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের রাগ হয় বলে অভিযোগ। তার ফলশ্রুতি, বইয়ের দোকানে ভাঙচুর। অষ্টমীতে আবার ওই জায়গায় বইয়ের স্টল তৈরি করতে যান ,সিপিএম নেতারা। তারা প্রতিবাদসভাও করেন। সেখান থেকেই বিকাশ, কমলেশ্বর-সহ অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুজো আছে, নেতা নেই
তাদের নামেই চলে এই পুজোগুলি। এবছরও হচ্ছে পুজো। কিন্তু নেতারা নেই। কেউ জেলে, কেউ পরলোকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নাকতলার পুজো
শহরবাসীর কাছে নাকতলার পুজো মানেই ‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো’। কিন্তু সম্প্রতি সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইডি-র হাতে গ্রেফতার হয়ে সংশোধনাগারে। পার্থের পুজো আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করলেও এইবছর নাকতলার পুজো উদ্বোধনে যাননি মুখ্যমন্ত্রী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উদ্বোধনে নেই
হেভিওয়েট নেতা পার্থকেও প্রতিবছর অন্যান্য পুজোর উদ্বোধন করতে হতো, কিন্তু এই বছর তিনি আলিপুর জেলে বন্দিদশা কাটাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোটা কাপড়
পার্থের পুজো নাকতলা উদয়ন সংঘের এইবছরের থিম ‘মোটা কাপড়’। যদিও পার্থহীন এই বছরের পুজোর জৌলুস এতটুকু কমেনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এবং অর্পিতা
পরপর দু’বছর নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোর মুখ ছিলেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। ২০১৯ এবং ২০২০, দুই বছরই উদয়ন সংঘের পুজোর পোস্টার থেকে হোর্ডিং, সর্বত্র জ্বলজ্বল করতেন অর্পিতা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্পিতা প্রধান অতিথি
প্রধান অতিথি হয়ে পুজোর পুরস্কার প্রদানও করেছেন অর্পিতা। নিজের আবাসন থেকে পুরনো পাড়ার পুজো, সর্বত্রই কোনও না কোনওভাবে দেখা গিয়েছে তাকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্পিতা জেলে
পার্থের সঙ্গী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ও এই পুজোয় প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেষ্টর পুজো
বোলপুরের নীচুপট্টি এলাকার এই বাড়ির সামনেই লাগানো হয়েছে তার এলাকার পুজোর ব্যানার। এবারের পুজো পাড়ায় নয় জেলেই কাটাতে হবে বীরভূমের কেষ্টকে। ইডি গ্রেপ্তার করেছে তাকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পারিবারিক গ্রাম
বীরভূমের নানুরের হাটসেরান্দি গ্রাম। অনুব্রতর পারিবারিক দুর্গাপুজো এখানে ‘মোড়ল বাড়ির পুজো’ নামেই খ্যাত। সেইবাড়ির মেজো ছেলে এই বছর পুজোয় থাকবে না। কমেছে পুজোর জাঁকজমকও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পারিবারিক দুর্গামন্দির
পারিবারিক দুর্গামন্দির প্রতিবারের মত রং করা হয়েছে। প্রথামাফিক পালিত হবে সব নিয়মই, কিন্তু অন্যান্য বারের মত এই বছর পুজোয় গ্রামে আসবে না ‘মোড়ল’ বাড়ির কেষ্ট।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কলকাতা থেকে মাছ
গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, কলকাতা থেকে চিংড়ি, ইলিশ, ভেটকি আসতো পুজোয়। খাসির মাংস হতো। সঙ্গে হরেক মিষ্টি। অনুব্রত জেলবন্দি থাকায় তেমন কোনও আয়োজন হচ্ছে না এ বার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সুব্রত নেই
প্রায় একবছর হতে চলল তিনি নেই। জীবদ্দশায় নিয়ম করে সময় পেলেই একবার ক্লাবে আসতেন। এই বছরের পুজোর সন্ধেগুলোয় আর রঙিন নকশা পেড়ে ধুতি পরে বসে থাকতে দেখা যাবে না ক্লাবের সভাপতিকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ক্লাব মনে রেখেছে
এখনও একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ছবি সামনে রেখেই এইবছর খুঁটিপূজা করা হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মণ্ডপে তার ছবি
এই পুজোকে ঘিরে নানান জায়গায় লাগানো রয়েছে ক্লাবের সাবেক সভাপতির স্মৃতিচিত্র। পুজোমণ্ডপে ঢোকার মুখেও রয়েছে তার ছবি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
13 ছবি1 | 13
সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূলের কর্মীরা বারবার ভাঙচুর করলেও তাদের ধরা হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সিপিএম নেতাদের। পুলিশের বক্তব্য, বইয়ের স্টল করা নিয়ে স্থানীয় পুজোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সিপিএমের বিরোধ চলছিল। শান্তিভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কায় পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। তৃণমূল বলছে, মানুষের অসুবিধা করে ভিড়ের মধ্যে কেন বইয়ের স্টল করা হবে?
একটা বইয়ের স্টল থেকে কী করে শান্তিভঙ্গ হবে? প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''বইয়ের স্টল তো সিপিএম আজ থেকে করছে না। দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনে সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সিপিএম তথা বাম নেতারা সাধারণত পুজোর আয়োজনের মধ্যে থাকতেন না। কিন্তু তারা মণ্ডপের কাছে বইয়ের স্টল দিতেন।'' আশিস জানিয়েছেন, ''সেখানে নিয়মিত বসতেন বিমান বসু-সহ দলের শীর্ষ নেতারা। ক্ষমতা হারানোর পরেও তারা বইয়ের স্টল দিচ্ছেন। গতবারও প্রচুর স্টল দিয়েছেন। শান্তিপূর্ণভাবে স্টল দেয়া নিয়ে কার কী আপত্তি থাকতে পারে? কলকাতায় রাস্তা বন্ধ করে পুজো করলেও তো অসুবিধা হয় না? গত ১১ বছরে তো বামেদের স্টল নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি!''
রাস্তা বন্ধ করে পুজো
রাস্তা বন্ধ করে প্যান্ডেল বাঁধার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল প্রশাসন। তা সত্ত্বেও কলকাতার পুজোয় সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নির্দেশ অমান্য
প্রশাসনের নির্দেশ অনুযায়ী, কোথাও রাস্তা আটকে পুজোর প্যান্ডেল করা যাবে না। কলকাতা-সহ রাজ্যের বহু জায়গায় রাস্তা দখল করে পুজো-প্যান্ডেল তৈরির কারণে যান চলাচলে ব্যাপক সমস্যা হয়। পুজো কমিটিগুলিকেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়ম মাফিক এমন নির্দেশিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নবান্নে অভিযোগ
রাস্তা আটকে প্যান্ডেল করার কারণে হয়রানির একাধিক অভিযোগ আগেও জমা পড়েছে নবান্নে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বছর তিনেক আগে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু কলকাতার বহু অঞ্চল ঘুরে দেখা গেল চিত্রটা বদলায়নি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মুখ্যমন্ত্রীর সতর্কবার্তা
শ্রীভূমির পুজোর উদ্বোধনে এসে ক্লাবের সভাপতি তথা রাজ্যের দমকল মন্ত্রী সুজিত বসুকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মজার ছলেই রাস্তা বন্ধ নিয়ে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, ''সুজিত, আমার রাস্তা যেন বন্ধ না হয়। লোকে প্লেন ধরতে পারল না, এটা যেন না হয়।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
গাড়ি প্রবেশের অনুমতি নেই
দমদম পার্ক অঞ্চলের অবস্থাও পুজোর কটা দিন বেশ অসুবিধেজনক হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় পুজো হয়। যে কারণে গাড়ি প্রবেশ করতেই দেয়া হয় না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
একডালিয়ার চাপ
দক্ষিণ কলকাতার এক হেভিওয়েট পুজো একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের পুজো। আশি বছরের এই পুজো এই রাস্তার ওপরেই হয়। প্যান্ডেল তৈরি শুরু হওয়ার পর থেকেই যানজট এই পথের প্রতিবছরের পরিচিত চিত্র। ঠিক পাশেই সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পড়ুয়াদের যাতায়াতের অসুবিধে নিয়ে অধিকাংশ অভিভাবকদের অভিযোগও রয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকারও জায়গা নেই
এই শহরে এমন বহু বড় বড় পুজো রয়েছে যেখানে দর্শনার্থীদের ভীড় স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সমস্যায় ফেলে। প্যান্ডেলের গেরোয় আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার পরিসরটুকুও থাকে না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দমকলের সমস্যা
এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই রাস্তা দখলের পুজোয় তাদের শুধু অসুবিধেই হয়না, তারা এই কদিন আতঙ্কেও থাকেন। এলাকায় যদি আগুন লাগে এই পথে দমকল পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারবে না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
7 ছবি1 | 7
লোকমতের রাজনৈতিক সম্পাদক শরদ গুপ্তা মনে করেন, ''বিরোধীরা পুজো করলে তাদের মণ্ডপে আলোর খেলা বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠবে, তাদের বইয়ের স্টলও রাখা হবে না, এ কোন অসহিষ্ণুতার পুজো দেখছি আমরা?'' শরদের প্রশ্ন, ''পুজোও কি শুধুই ক্ষমতাসীনদের পুজোতে পরিণত হবে? উৎসব সকলের। প্রকৃত অর্থেই সকলের। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবার।''
আশিস ও শরদ বলছেন, ''উৎসবে রাজনীতির রঙ বিবেচ্য নয়, বিচার্য হচ্ছে ভাললাগার রঙ, ভালোবাসার, সম্প্রীতির, সৌর্ভ্রাতৃত্বের রঙ। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া এই পুজোর মধ্যে দয়া করে সংকীর্ণতা ঢুকতে দেবেন না। রাজনৈতিক নেতারা পুজো করুন। কিন্তু সেখানে রাজনীতির রঙ যেন প্রবেশ না করে, সেই পুজো যেন উৎসেবর প্রতীক হয়। রাজ্যে যে দুর্নীতি, বেনিয়মের ভয়ংকর অভিযোগ উঠছে, তার ছোঁয়া থেকে পুজো বাদ থাক।''
কলকাতার থিমের পুজো
06:52
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ''পুজোর ভিড়ে স্টল খুলতে হবে কেন? পরে রোববার দেখে ওরা এসব করতে পারেন।'' আশিস বলছেন, পুজোয় তো জাগো বাংলার স্টলও খোলা হয়। আর বইয়ের স্টল কবে খুলতে হবে, সেটাও ঠিক করে দেবেন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা? তারাই বলে দেবেন, বিরোধীরা কী করে জনসংযোগ করবেন? তারা ফতোয়া দেবেন, কোন বই বা কাগজ পড়বে মানুষ, অথবা পুজোর দিনে, উৎসবের দিনে বইয়ের স্টল কারা দেবে, মানুষ কাদের কাছে বই কিনবেন?
কমলেশ্বরকে গ্রেপ্তার করার পর পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় টুইট করে বলেছেন, ''বইকে ভয়? কমলেশ্বরকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে নিন্দার ভাষা নেই। যে কোনো মূল্যে কমলেশ্বরের পাশে থাকব। ''অন্য বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য অধিকাংশই নীরব আছেন।