অ্যান্টার্কটিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে না বলে অনেকদিন মনে করা হয়েছিল৷ কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখা যাচ্ছে, উষ্ণায়নের প্রভাব সেখানেও পড়ছে৷
গবেষকদের মতে,পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় সাগরে ভাসা বরফ যদি গলা শুরু করে তাহলে এর আইস সেল্ফও গলবেছবি: JOHAN ORDONEZ/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
পূর্ব অংশের তুলনায় সেখানকার বরফ গলার গতি একটু দ্রুত বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন৷
পৃথিবীর বৃহত্তম মেরু মরুভূমি কীভাবে তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে গবেষকেরা অনেকদিন ধাঁধায় ছিলেন৷ তবে সাধারণ ঐকমত্য ছিল যে, বরফের চাদর প্রথমে আজকের অ্যান্টার্কটিকার কেন্দ্রে আকার ধারণ করেছিল এবং সেখান থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল৷
কিন্তু বর্তমানে নতুন এক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আসলে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বছর আগে মহাদেশের পূর্ব অংশে প্রথম বরফ তৈরি হয়েছিল৷ এরপর পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা জুড়ে তা বিস্তৃত হতে কমপক্ষে সাত মিলিয়ন বছর সময় নেয়৷ ঐ সময় পৃথিবীর অবস্থা গ্রিনহাউস থেকে বর্তমানের আইসহাউস ক্লাইমেটে রূপ নেয়৷
পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা থেকে প্রথমবারের মতো সংগৃহীত পলির নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্য জানা গেছে৷ গবেষকেরা পানির উপরিভাগ থেকে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে সমুদ্রের তলদেশের ১০ মিটার নিচে গর্ত খনন করেছিলেন৷ এভাবে সংগৃহীত নমুনা জার্মানির ব্রেমারহাফেন শহরের ফর পোলার অ্যান্ড মেরিন রিসার্চে সংরক্ষণ করা আছে৷ এগুলো পরীক্ষা করে কোন সময় কোন জলবায়ু পরিস্থিতি বিরাজ করতো, তা জানা যেতে পারে৷
বিশেষ স্ক্যানের মাধ্যমে গবেষকরা নির্ধারণ করেছেন যে, অ্যান্টার্কটিকার পশ্চিমে ভূমির গঠন পূর্বের ভূমির গঠন থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা৷ বর্তমানে আইস ক্যাপ-এর পশ্চিম অংশের অনেক আইস শিট উষ্ণ সমুদ্রের জলে অবস্থিত- যা সমস্যা বয়ে আনতে পারে৷
হেলমহলৎস সেন্টারের ভূতত্ত্ববিদ ইয়োহান ক্লাগেস বলেন, ‘‘পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় বরফ জমা হতে অনেক বেশি সময় লাগলেও তা পুরো অদৃশ্য হয়ে যেতে অনেক কম প্রচেষ্টা লাগবে৷ এই প্রেক্ষাপটে ‘প্রচেষ্টা'র অর্থ হলো, তাপমাত্রা এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডে সামান্য পরিবর্তন বরফ অত্যন্ত দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে৷
অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইনদের বর্তমান ও অতীত
অ্যান্টার্কটিকার প্রাণিবৈচিত্র্য রক্ষা, বিশেষ করে পেঙ্গুইনদের আবাস রক্ষায় অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ ২৫ এপ্রিল বিশ্ব পেঙ্গুইন দিবসে তারা এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/R. Linke
‘সেরা দূত’
পেঙ্গুইন-অনেকেরই পছন্দের প্রাণি, কেননা মাতালের মতো এদের অদ্ভুত চলাফেরা সবাইকে আকৃষ্ট করে৷ আর এ থেকেই গবেষকরা তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন৷ ফিশারিজ বায়োলজিস্ট ক্রিস্টিয়ান রাইস বলেছেন, ‘‘পেঙ্গুইনরা হলো দক্ষিণ মহাসাগরের সেরা দূত, যাদের মাধ্যমে সেখানকার প্রাণিদের প্রয়োজন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়৷’’
ছবি: Alain De Broyer
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্বে পেঙ্গুইনের ১৮টি প্রজাতি রয়েছে৷ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত মোট পেঙ্গুইনের দুই তৃতীয়াংশের বাস এখানে৷ ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, অ্যান্টার্কটিকায় পেঙ্গুইনের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়ায় আবাসন সংকটে রয়েছে ‘কোট পড়া ভদ্রলোকেরা’৷ পানি উষ্ণ হওয়ায় তাদের খাওয়ার অভাব দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/R. Linke
চাপের মুখে
পেঙ্গুইনদের প্রধান খাবার কিল মাছ৷ এই মাছদের ধরা , সমুদ্রে দূষণ, পেঙ্গুইনদের প্রজনন অঞ্চল ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে পেঙ্গুইনদের সংখ্যা কমার জন্য দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা৷ কেবল অ্যাডেলিয়ে এবং কিং -এই দুটি প্রজাতির পেঙ্গুইনই সংখ্যায় বাড়ছে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/E. Hummel
অবিলম্বে কাজ শুরু করা প্রয়োজন
পেঙ্গুইন তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় সমুদ্রে কাটায়৷ প্রজনন এবং ডিম ফোটানোর জন্য পানি ছেড়ে উপরে উঠে আসে৷ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বিজ্ঞানী ক্যাস্যান্ড্রা ব্রুকস বলেছেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং পেঙ্গুইনের সংখ্যার মধ্যে জটিল রসায়নের জট ছাড়ানোর জন্য এখনই বিজ্ঞানীদের কাজ শুরু করা প্রয়োজন৷’’
ছবি: picture-alliance/Photoshot
বাস্তু সংস্থান
অ্যান্টার্কটিকার ‘রশ সি’ উপসাগর বিশ্বের এমন একটি সমুদ্র বাস্তুসংস্থান যেটি এখনও পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছে৷ পেঙ্গুইনদের এই অভয়ারণ্যটিতে গবেষণার কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা৷ এই দুই দেশ মিলিতভাবে রশ সি-তে অ্যান্টার্কটিকার সামুদ্রিক প্রাণিদের জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকা বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছে৷ গত বছর এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিও হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/R. Linke
সর্ববৃহৎ পেঙ্গুইন
১৮ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতির পেঙ্গুইনরা হলো ‘এমপেরর’ অর্থাৎ সম্রাট৷ এরা ১২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, ওজন হয় ৪০ কেজির মতো৷ তবে বছরের বিভিন্ন সময় ওজনের তারতম্য হয়৷ অ্যান্টার্কটিকায় যে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায়, এক সময় পেঙ্গুইনদের আকার কত বড় ছিল৷ ৩ কোটি ৭০ লাখ বছর আগে তারা অ্যান্টার্কটিকায় রাজত্ব করত৷ তখন তাদের উচ্চতা ছিল ২ মিটার এবং ওজন কোনো কোনোটার ১১৫ কেজি পর্যন্ত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images(H. Reinhard
দূরের পথের যাত্রী
অ্যান্টার্কটিকায় বাস করা ৫ প্রজাতির পেঙ্গুইনের মধ্যে একটি অ্যাডেলিয়ে৷ অন্যরা হলো এমপেরর, জেনটু, চিনস্ট্র্যাপ এবং ম্যাকারনি পেঙ্গুইন৷ অ্যাডেলিয়ারা দারুণ সাঁতারু, এদের অনেকের সাঁতারের রেকর্ড ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত, অর্থাৎ একবারে যাওয়া আসায় ৩০০ কিলোমিটার সাঁতরাতে পারে তারা৷ সন্তানদের খাবার সংগ্রহের জন্য তারা এই দূর পথ পাড়ি দেয়৷
ছবি: AP
7 ছবি1 | 7
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এক ধরণের ডমিনো এফেক্ট দেখা দিতে পারে: পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় সাগরে ভাসা বরফ যদি গলা শুরু করে তাহলে এর আইস সেল্ফও গলবে- এমনকি এর নিচে থাকা ‘স্থায়ী' বরফও দ্রুত গলতে থাকবে৷ তখন সেখানে বাস করা প্রজাতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে৷ সমুদ্রের বরফ সরে গেলে সিল ও পেঙ্গুইনরা তাদের আবাসস্থল হারাবে৷ পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় থাকা থোয়াইটস হিমবাহ একদিন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে৷
ক্লাগেস বলেন, ‘‘ধরুন আমরা যদি পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বরফ সম্পূর্ণ গলে যেতে দেই, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিন থেকে পাঁচ মিটার বৃদ্ধি পাবে, যা এই ঘরের উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি৷ এবং অবশ্যই এটি বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে৷''
গবেষকেরা আশা করছেন, তাদের গবেষণা কার্বন নির্গমন কমানোর তাড়না আরেকটু বাড়াবে৷ পৃথিবীর ইতিহাস জুড়েই নিয়মিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে৷ কিন্তু এবার এটি আমাদের কারণে হচ্ছে৷
ক্লাগেস বলেন, ‘‘আমাদের বুঝতে হবে, এটি পৃথিবীকে ‘বাঁচানো' বা পরিবেশ বা অন্য কিছু রক্ষার বিষয় নয়৷ এটি স্পষ্টতই নিজেদের রক্ষার বিষয়, যেন আমরা এই গ্রহে যুক্তিসঙ্গতভাবে ভালোভাবে বসবাস করা চালিয়ে যেতে পারি৷''
পৃথিবীর বৃহত্তম মেরু মরুভূমি নিয়ে গবেষণা আমাদের শুধু আমাদের গ্রহের সুদূর অতীত সম্পর্কেই নয়, বরং এর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানাচ্ছে৷