সমাজ, পরিস্থিতি এবং পীড়িত মানবজাতির সংকট বোঝাতে অনেক সময় ছবিই হয়ে ওঠে একমাত্র মাধ্যম৷ তাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ থেকে ভেনেজুয়েলার প্রতিবাদ সবই হয়ে ওঠে অনবদ্য ছবির উপজীব্য৷
বিজ্ঞাপন
মানবজাতির আতর্নাদ বা সঙ্কট ভেনেজুয়েলার ফটোগ্রাফার রোনাল্ডো শেমিদ তাঁর ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করে জিতে নিয়েছেন চিত্রসাংবাদিকতার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অ্যাওয়ার্ড’৷
কী ছিল সেই ছবির বিষয়? সমস্যায় জর্জরিত সমাজের প্রতিফলন ঘটাতে রোনাল্ডো তাঁর ফটোর কম্পোজিশন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিজের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশকে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক বিক্ষোভকারী ছুটছেন৷ তাঁর সর্বাঙ্গে আগুনের শিখা৷ এই ছবিটি ভেনেজুয়েলার সরকারবিরোধী প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল৷
গত বছর অশান্ত হয়ে উঠেছিল ভেনেজুয়েলা৷ প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছিলেন৷ সেই প্রয়াস রুখতে পথে নামে জনতা৷ সেই উত্তপ্ত ভেনেজুয়েলার কারাকাসে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় এক বিক্ষোভকারীর গায়ে আগুন লাগে৷ ৩ মে এই সংঘর্ষ চলাকালীন একটি মোটরবাইকেলের গ্যাস ট্যাংকে বিস্ফোরণ ঘটে৷ তাতেই সালাজার নামে এই বিক্ষোভকারীর শরীরে আগুন লাগে৷ অগ্নিদগ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচেছিলেন তিনি৷ এই ঘটনাই রোনাল্ডোর আলোকচিত্রে উঠে আসে সার্থকভাবে৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবে আলোকচিত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে৷ সাধারণ সংবাদ বিভাগে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরলেন অস্ট্রেলীয় আলোকচিত্রী প্যাট্রিক ব্রাউন৷ রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সংবাদ মাধ্যমে ইতিমধ্যে নানাভাবে উঠে এসেছে৷ প্যাট্রিক অনেকটা সেই পথে হেঁটেই একটি নৌকাডুবির পরের দৃশ্যের ছবি তুলেছেন৷ কমপক্ষে ১০০ রোহিঙ্গা এই নৌকা করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের মাটি ছোঁয়ার আগেই এই নৌকাডুবি হয়৷ তাতে মাত্র ১৭ জন বেঁচেছেন৷ রোহিঙ্গাদের মৃতদেহের সেই সারবদ্ধ ভয়ার্ত ছবি খুব দক্ষতার সঙ্গে উঠে এসেছে প্যাট্রিক ব্রাউনের ছবিতে৷
ছবি শুধু ছবি হলেই চলবে না৷ তার মধ্যে থাকতে হবে মৌলিক সংবাদের গুরুত্বও৷ সেই মাপকাঠিতেই নির্ধারণ করা হয় ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’র পুরস্কার৷
২০১৮ সালে মূল পুরস্কারের জন্য ছয়টি আলোকচিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন বিচারকেরা৷ অন্যান্য আটটি বিভাগের প্রতিটির জন্য সমসংখ্যক ছবি বেছে নেওয়া হয়েছে৷ সব মিলিয়ে সেরা চিত্রসাংবাদিক হওয়ার দৌড়ে আছেন ২২টি দেশের ৪২ জন চিত্রসাংবাদিক৷ এঁদের মধ্যে ১৫ জন অতীতেও সম্মানিত হয়েছেন৷ ২৭ জন নতুন মুখ৷
ভবিষ্যতে চিত্রসাংবাদিকতার সম্ভাবনা যে প্রচুর, সে নিয়ে আশাবাদী এবারের প্রতিযোগিতার অন্যতম বিচারক এবং প্যারিস ম্যাচ পত্রিকার চিত্র বিভাগের প্রধান জেরোমে হফার৷ তিনি বলেন, ‘‘আশা করা যায় ছবিগুলির গুণমান উন্নত হবে, সংবাদের ভাষ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে নয়া আঙ্গিক দেখা যাবে৷’’
স্টুয়ার্ট ব্রাউন/ পিএস
বিশ্বজয় করল বাংলাদেশের যৌনকর্মীর ছবি
সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড জয় করা ছবিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের দুর্দশাসহ লিবিয়ার যোদ্ধাদের কথাও উঠে এসেছে৷ চলুন এক নজরে দেখে নিই ছবিগুলো৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/S. Hoyn
ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ
চীনের দুই জমজ বোন লিউ বিংকুইং এবং লিউ ইউজির অনুশীলনের এই ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী ইউয়ান পেং৷ ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এই দুই বোন৷ ছবিটি সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭-র স্পোর্টস ক্যাটাগরিতে সেরা হয়েছে৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/Y. Peng
নিশাচর হায়না
ব্রিটেনের আলোকচিত্রী উইল ব্যুরাড-লুকাস নিজস্ব পরিবেশে থাকা বিভিন্ন নিশাচর প্রাণীর ছবি তোলেন৷ হায়নার এই ছবিটি তোলা হয়েছে আফ্রিকায়৷ ‘নেচার’ ক্যাটাগরিতে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে এটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/W. Burrard-Lucas
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন পতিতালয়ের ছবি
জার্মান আলোকচিত্রী সন্ড্রা হাইন-এর একটি ফটো সিরিজে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন এবং অন্যতম বড় পতিতালয়ের এই ছবিটি৷ কান্দাপাড়া পতিতালয়ে সাতশ’রও বেশি যৌনকর্মী বদ্ধ পরিবেশে কাজ করেন৷ অনেক শিশুও সেখানে বড় হয়৷ ‘ডেইলি লাইফ’ ক্যাটাগরিতে সেরা হয়েছে এটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/S. Hoyn
কলম্বিয়ার এক অন্ধকার দিক
কলম্বিয়ার আলোকচিত্রী হেনরি আগুডেলো তাঁর দেশের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন৷ গত পঞ্চাশ বছরে সে দেশের এক লাখ ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ ‘গায়েব’ হয়ে গেছে৷ অনেকের মরদেহ পাওয়া গেলেও তা সনাক্ত করা সম্ভব ছিল না৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীরের নানা চিহ্ন (যেমন ছবির এই ট্যাটুটি) পরিচয় সনাক্তে সহায়ক হয়েছে৷ ‘স্টিল লাইফ’ ক্যাটাগরিতে সেরা পুরস্কার জিতেছে ছবিটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/H. Agudelo
যুদ্ধের মাঝে বিশ্রাম
আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাঝখানেই বিশ্রাম নিচ্ছেন লিবিয়ার এক সেনা৷ ইটালীয় আলোকচিত্রী আলিসিও রোমেনসি গত নভেম্বরে সির্ত শহরে এই ছবিটি তুলেছিলেন৷ ‘কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড নিউজ’ ক্যাটেগরিতে পুরস্কার জিতেছে এটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/A. Romenzi
শীতকালে বদলে যাওয়া পরিবেশ
আলবেনিয়ার কোনো এক জায়গার এই ছবিটি তুলেছেন ফ্রিডরিক বাইক্স৷ বেলজিয়ামের এই আলোকচিত্রী চেয়েছিলেন শীতকালের শুরুতে পরিবেশ কিভাবে বদলে যায় সেটা তুলে ধরতে৷ ল্যান্ডস্কেপ ক্যাটেগরিতে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে এটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/F. Buyckx
এক অন্দরমহলের ছবি
সৌদি আলোকচিত্রী তাসনিম আলসুলতান তাঁর দেশের ইসলামি সমাজের অন্দরমহলের এই ছবিটি তুলেছেন৷ ছবিতে একজন তালাকপ্রাপ্ত একক মা এবং তাঁর সন্তানকে দেখা যাচ্ছে৷ সৌদি আরবে তালাক বিরল ব্যাপার, তবে কোনো নারী তালাকের শিকার হলে তাঁকে অনেকটা একঘরে করে দেয়া হয়৷ ‘কারেন্ট টপিকস’ ক্যাটাগরিতে সেরার পুরস্কার জিতেছে ছবিটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/Tasneem Alsulta
শহরের নানা রূপ
চীনের ফটোগ্রাফার ডঙ্গির উদ্দেশ্য হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থাপনার প্রকৃত দৃশ্য তুলে ধরা৷ এভাবে তিনি বিভিন্ন শহরকে ছবিতে নতুনভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন৷ ‘আর্কিটেকচার’ ক্যাটেগরিতে সেরার পুরস্কার জিতেছে ছবিটি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/Dongni
‘পার্ফেক্ট নারী’ বলে কি কিছু আছে?
রুশ ফটোগ্রাফার জর্জ মেয়ার ভিন্নধারার পোর্টেট তুলতে বিশেষ পারদর্শী৷ লাইট এবং শ্যাডো নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন তিনি৷ ফলে তাঁর ছবির মডেলদের দেখতে অনেক সময় অবাস্তব মনে হতে পারে৷ সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭-র ‘পোর্টেট’ ক্যাটেগরিতে পুরস্কার জয় করেছেন তিনি৷
ছবি: Sony World Photography Award 2017/G. Mayer
সহায়তা নিয়ে আত্মহত্যা
সুইস ফটোগ্রাফার সাবিনা কাটানিও এক স্পর্শকাতর বিষয় তাঁর ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন৷ সেটা হচ্ছে চিকিৎসকের সহায়তা নিয়ে আত্মহত্যা৷ সুইজারল্যান্ডে এমন আত্মহত্যার সুযোগ রয়েছে৷ ছবিতে যে গাড়িটি দেখা যাচ্ছে, তাতে ২০০৭ সালে চিকিৎসকের সহায়তায় আত্মহত্যা করেছিলেন দুই জার্মান৷