সোমবার ছিল যৌনাঙ্গচ্ছেদ বিরোধী বিশেষ আন্তর্জাতিক দিবস৷ এই দিনে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী যৌনাঙ্গচ্ছেদ বন্ধের জোর আহ্বান জানায়৷ ডয়চে ভেলে তানজানিয়া আর গিনি-বিসাউয়ের উপর এই প্রতিবেদনটি করেছে৷
বিজ্ঞাপন
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে পালিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ডে অব জিরো টলারেন্স অব ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন৷ তো সারা বিশ্বে যখন যৌনাঙ্গচ্ছেদ বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে, তখন তানজানিয়া আর গিনি-বিসাউয়ের পরিস্থিতি কেমন?
কিলিমাঞ্জারো পর্বতের খুব কাছে তানজানিয়ার মানইয়ারা গ্রাম৷ ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ঘটনা৷ এক দাদী ছুরি দিয়ে তার নাতনীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ করেছেন৷ দুই সপ্তাহেও রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় ঐ মেয়েটির হাসপাতালে মৃত্যু হয়৷ তার বয়স ছিল ১৭ বছর৷ তানজানিয়ায় নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ নিষিদ্ধ হয়েছে ২০ বছর আগে৷ কিন্তু এমন কিছু ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, নিষিদ্ধ হলেও নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ এখনো বন্ধ হয়নি৷
তানজানিয়ার উত্তর পশ্চিমের মারা অঞ্চলের পুলিশ কর্মকর্তা সমু নাসোনগোমা ডয়চে ভেলেকে জানালেন, তাঁরা নতুন নতুন ঘটনার খবর পাচ্ছেন৷ যৌনাঙ্গচ্ছেদ করায় অনেককে গ্রেপ্তারও করেছেন, কিন্তু আদালতে সবাই রেহাই পেয়ে যায়৷
যৌনাঙ্গচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে মিমুতি নামে একটি সংগঠন৷ সংগঠনের প্রধান রোজ নিজিলো জানালেন, তানজানিয়ার উত্তরাঞ্চলের ২৫ শতাংশেরও বেশি নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ হয়েছে৷ গত দুই বছর ধরে এফজিএম বা নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা৷ যৌনাঙ্গচ্ছেদ অবৈধ হওয়ার পরও প্রত্যন্ত ও যাযাবর গোষ্ঠীর মধ্যে এর প্রচলন খুব বেশি বলেও জানালেন তিনি৷ যৌনাঙ্গচ্ছেদের ফলে যে মানবদেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ বিষয়ে মাসাই এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী অবহিত নয়৷ তাঁদের ধারণা, এটা তাঁদের সংস্কৃতির অংশ এবং এর ফলে একজন মেয়ে নারীতে পরিণত হয়৷
প্রতিবাদ সত্ত্বেও চলছে নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ
আফ্রিকার দেশগুলোতে এখনো চলছে নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ৷ যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা নিষিদ্ধ৷ ঐতিহ্য রক্ষার নামে নারীর উপর বর্বর নির্যাতনের কিছু ছবি পাবেন এই ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/S. Modola
সবার জন্য একই ব্লেড
কেনিয়ার রিফ্ট গ্রামের এই নারী হাতে থাকা ব্লেডটি দিয়ে ইতোমধ্যে চারজনের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করেছেন৷ পোকোট জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য অনুযায়ী, ব্লেড দিয়ে মেয়েদের যৌনাঙ্গের বাইরের অংশ কেটে বা যৌনাঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁদের মেয়ে থেকে নারীতে পরিণত করা হয়৷ যদিও বিশ্বের অনেক দেশে এটা নিষিদ্ধ, তাসত্ত্বেও অনেক নারী এখনো এই বর্বরতার শিকার হন৷
ছবি: Reuters/S. Modola
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি
যৌনাঙ্গচ্ছেদের অনুষ্ঠান বা আচার শুরুর আগের প্রস্তুতির ছবি এটি৷ পোকোট জনগোষ্ঠীর নারী এবং শিশুরা আগুনের পাশে বসেছেন শীত থেকে বাঁচতে৷ এখানকার নারীদের মধ্যে যাঁরা যৌনাঙ্গচ্ছেদ বা ‘ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন’ (এফজিএম) করতে চান না, তাঁদের সহজে বিয়ে হয় না৷ আর প্রত্যন্ত এই এলাকায় বিয়ে ছাড়া মেয়েদের পক্ষে চলা কার্যত অসম্ভব৷
ছবি: Reuters/S. Modola
বাধা দেয়া সম্ভব নয়
যোনাঙ্গচ্ছেদের আগে মেয়েদের উলঙ্গ করে ধোয়া হয়৷ এর ফলে পরবর্তীতে তাঁদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে, কারণ তাঁদের মায়েদেরও সমস্যা হয়েছে৷ যৌনাঙ্গচ্ছেদের কারণে সংক্রমণ, বন্ধ্যাত্ব এমনকি সন্তান জন্ম দেয়ার সময় সমস্যাও হতে পারে৷ আফ্রিকার ২৮টি দেশে, আরব উপদ্বীপে এবং এশিয়ার কিছু দেশে এখনো এই চর্চা রয়েছে৷ ইউরোপের অভিবাসী মেয়েরাও অনেক সময় এই ঝামেলায় পড়েন৷
ছবি: Reuters/S. Modola
ভীতিকর পরিস্থিতি
রিফট উপত্যকার একটি কুঁড়েঘরে যৌনাঙ্গচ্ছেদের জন্য অপেক্ষা করছেন কয়েকজন পোকোট মেয়ে৷ ২০১১ সালে কেনিয়া সরকার এই চর্চা নিষিদ্ধ করেছে৷ তবে ইউনিসেফ-এর প্রকাশিত তথ্য অনযায়ী, দেশটির ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি অন্তত ২৭ শতাংশ মেয়ের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/S. Modola
ব্যথা সহ্য করে থাকতে হবে
একজন খৎনাকারী একটি মেয়ের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করছেন৷ স্থানীয়রা আশা করেন যে, মেয়েরা এ সময় মুখ বুজে ব্যথা সহ্য করে যাবে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, দশ শতাংশ মেয়ে যৌনাঙ্গচ্ছেদের সময় মারা যায়৷ আরো ২৫ শতাংশ মারা যায় যৌনাঙ্গচ্ছেদের কারণে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতার কারণে৷ সোমালিয়ার ৯৮ শতাংশ মেয়ে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার৷
ছবি: Reuters/S. Modola
পাথরের উপর রক্ত
একেক গোষ্ঠী একেকভাবে যৌনাঙ্গচ্ছেদ করে থাকে৷ পোকোট সম্প্রদায় যোনিদ্বার কেটে ফেলে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মূলত তিনভাবে যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়৷ প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে, ক্লিটোরিয়াস বা ভঙ্গাকুর কেটে ফেলা৷ দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, যোনিদ্বারের বাইরের এবং ভেতরের কিছু অংশ কেঁটে ফেলা হয়৷ আর তৃতীয় পদ্ধতিতে কার্যত যোনিদ্বার পুরোটা কেটে সমান করে ফেলা হয়৷
ছবি: Reuters/S. Modola
সাদা রং করা
পোকোটদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে মেয়েদের দেহে সাদা রং করা হয়৷ তারা আগে থেকেই ধরে নেয় যে, এতে করে সংক্রমণে বা মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে মেয়েটি মারা যেতে পারে৷ এমন বর্বরতা থেকে মেয়েদের বাঁচাতে ২০১৪ সালে বিশেষ পুলিশ বাহিনী তৈরি করেছে কেনিয়া৷
ছবি: Reuters/S. Modola
জীবনভর যন্ত্রণা
যৌনাঙ্গচ্ছেদের পর একটি মেয়েকে পশুর চামড়া জড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ পোকোট জনগোষ্ঠীর ধারা অনুযায়ী, মেয়েটি এখন বিয়ের উপযোগী হয়েছে৷ অনেক উপজাতী গোষ্ঠী মনে করে, এফজিএম হচ্ছে স্বাস্থ্যকর ব্যাপার৷ এরফলে মেয়েরা আরো বেশি গর্ভধারণের উপযোগী হয় এবং স্বামীর প্রতি অনুগত থাকে৷
ছবি: Reuters/S. Modola
মা থেকে মেয়েতে?
এই কিশোরী কোনোদিন যৌনাঙ্গচ্ছেদের যন্ত্রণার কথা ভুলবে না৷ কিন্তু ভবিষ্যতে সে কি এই ব্যথা থেকে তার মেয়েকে রক্ষা করতে পারবে? কিছু দেশে এখন শিশুদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়৷ কেননা বাচ্চাদের করা হলে সেটা আলাদাভাবে মানুষের নজর কাড়ে না!
ছবি: Reuters/S. Modola
9 ছবি1 | 9
নিষেধাজ্ঞার পরও গিনি-বিসাউয়ে চলছে যৌনাঙ্গচ্ছেদ
২০১১ সাল থেকে আফ্রিকার এই দেশটিতে নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ নিষিদ্ধ৷ কিন্তু মুসলিমদের একটি অংশ এখনো তা চালিয়ে যাচ্ছে৷ দেশটিতে ৪০টি আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস এবং মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মুসলিম৷ রাজধানী মিসরা'র মুসলিমদের প্রধান ইসাইয়া জেলো ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘গিনি-বিসাউয়ের ৯৫ শতাংশ মুসলমান বিশ্বাস করেন, ইসলামে নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে৷ এই দেশে হাজার বছর ধরে ইসলামিক আদিবাসীদের মধ্যে এই প্রথা চলে আসছে৷'' জেলো নিজেও বিশ্বাস করেন, নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা উচিত৷
তবে দেশটির সাবেক পরররাষ্ট্র মন্ত্রী ফাতুমাতা ডিজো এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ তাঁর মতে, গিনি-বিসাওয়ের পুরুষরা নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদে বাধ্য করে৷ তারাই প্রচার করে, এটা নাকি ধর্মীয় অনুশাসন৷ অনেকে এমনও প্রচার করে যে, কোরানে যৌনাঙ্গচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে৷ বেশিরভাগ নারীই তাদের কথা বিশ্বাস করেন, কেননা, তাঁরা নিজেরা পড়তে, লিখতে জানেন না৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গিনি-বিসাউয়ের অর্ধেক নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে৷ তবে বিভিন্ন সংগঠনের প্রচারণার কারণে ১৪৬ টি গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায় নারীদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ বন্ধে সম্মত হয়েছে৷ তবে এজন্য শিক্ষা এবং সচেতনতা খুব জরুরি বলে মনে করেন ফাতুমাতা৷