নতুন ক্রাউন প্রিন্স আসার পর সৌদি আরবের নারীরা একের পর এক সুবিধা পেতে শুরু করেছেন৷ এবার পুরুষের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা শুরুর অনুমতি পেলেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
দেশটির ব্যবসা ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘অভিভাবকের কাছ থেকে পাওয়া অনুমতিপত্র থাকার প্রমাণ ছাড়াই এখন নারীরা ব্যবসা শুরু করতে পারবেন এবং সরকারের ই-সেবাগুলো ভোগ করতে পারবেন৷’’
সৌদি আরবে চালু থাকা অভিভাবক ব্যবস্থার আওতায় সরকারি সেবা পেতে কিংবা ভ্রমণে যেতে, স্কুলে ভর্তি হতে গেলে নারীকে তাঁর ‘অভিভাবকের’ কাছ থেকে পাওয়া অনুমতিপত্র দাখিল করতে হয়৷ এক্ষেত্রে অভিভাবক হন সাধারণত স্বামী, বাবা কিংবা ভাই৷
তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব৷ তাই সম্প্রতি বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি৷ নারীদের ব্যবসা শুরুর অনুমতি দেয়া সেই পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে৷
সৌদি আরবে বক্সিং শিখছেন নারীরা
সৌদি আরবের নারীরা অন্যান্য দেশের নারীদের মতো অনেক কিছু করতে পারেন না৷ তবে সম্প্রতি এক সৌদি নারী অন্য মেয়েদের বক্সিং প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছেন৷
জেদ্দায় জন্ম নেয়া হালা আল-হামরানি তাঁর শহরে ‘এফএলএজিবক্সিং’ নামে একটি ব্যক্তিগত জিম (শরীরচর্চা কেন্দ্র) চালু করেছেন৷ এফএলএজি মানে হচ্ছে ‘ফাইট লাইক এ গার্ল’৷ সেখানে মেয়েদের বক্সিং শেখান তিনি৷
স্কুলে পড়ার সময় ১২ বছর বয়সে প্রথম মার্শাল আর্টের প্রতি আকৃষ্ট হন আল-হামরানি৷ এরপর যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়ে বক্সিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পান তিনি৷ ফলে সৌদি আরবের প্রথম নারী বক্সিং প্রশিক্ষক হচ্ছেন আল-হামরানি৷
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে আল-হামরানির কাজ নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে৷ তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যেও তাঁর কর্মকাণ্ডের খবর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে অন্য অনেক মেয়েও এখন বক্সিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে৷
এখন নিজের ব্যক্তিগত জিমে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আল-হামরানি৷ তবে ভবিষ্যতে সৌদি সরকার মেয়েদের জন্য জিম প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স বা অনুমতি দিলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও জিম খোলার ইচ্ছা আছে তাঁর৷
জেদ্দা শহরের যেখানে জিমটি অবস্থিত তার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষ তাঁর কাজ সমর্থন করেন বলে মনে করেন আল-হামরানি৷ অবশ্য রক্ষণশীল মানুষরাও আছেন, যাঁরা এর বিরোধিতা করেন৷ তবে এসব বিরোধিতা তাঁকে দমাতে পারেনি৷
২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে সৌদি নারীরা প্রথমবারের মতো অংশ নেয়৷ ভবিষ্যতে সৌদি নারী বক্সারদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সহায়তা করতে চান আল-হামরানি৷
আল-হামরানি বলেন, একটা সময় ছিল যখন সৌদি আরবে মেয়েদের বেড়ে ওঠার সময় খেলাধুলা করাটাকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হত না৷ তবে দিন বদলাচ্ছে৷ এখনকার মেয়েরা মনে করছে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত খেলাধুলা প্রয়োজন৷ তাই তারা বক্সিংসহ অন্যান্য খেলার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে৷
‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছে সৌদি আরব৷ এর আওতায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে মোট জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷
নতুন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ‘ভিশন ২০৩০’ প্রণয়নের মূল ব্যক্তি বলে মনে করা হচ্ছে৷ গত অক্টোবরে তিনি একটি ‘মধ্যপন্থি ও খোলা’ সৌদি আরব গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন৷
চলতি মাসে দেশটির পাবলিক প্রোসিকিউটর কার্যালয় প্রথমবারের মতো নারী তদন্তকারী নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে৷
এছাড়া বিমানবন্দর ও সীমান্তে প্রথমবারের মতো ১৪০ জন নারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল সরকার৷ এক লক্ষেরও বেশি নারী এতে আবেদন করেন বলে জানা গেছে৷
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান গাড়ি চালানো বিষয়ে নারীদের উপর থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন৷ আগামী জুন মাস থেকে তা কার্যকর হবে৷
জেডএইচ/এসিবি (এএফপি)
গত সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন..
যে ১০টি অধিকার পেয়েছেন সৌদি আরবে নারীরা
ছবিঘরে দেখে নিন কবে আর কী কী অধিকার পেয়েছেন সৌদি নারীরা, সে দেশের নারী জাগরণে যা মাইলফলক হয়ে থাকবে৷
ছবি: Getty Images/AFP
১৯৫৫: মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল, ১৯৭০: মেয়েদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এখন বিপুল সংখ্যক ছাত্রীকে স্কুলে যেতে দেখা যায়৷ কিন্তু আজ থেকে ৬২ বছর আগে চিত্রটা এমন ছিল না৷ সৌদি আরবে মেয়েদের প্রথম স্কুল দার আল হানান৷ আর রিয়াদ কলেজ অফ এডুকেশন সৌদি নারীদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি চালু হয় ১৯৭০ সালে৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Nureldine
২০০১: নারীদের জন্য পরিচয়পত্র
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷ সৌদি আরবে নারীদের পরিচয়পত্র নিতে হলে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন হতো৷ ২০০১ সালে সৌদি নারীরা পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পরিচয়পত্র নেয়ার সুযোগ পান৷
ছবি: Getty Images/J. Pix
২০০৫: জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ
২০০৫ সালে সৌদি আরবে নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ হয়৷
ছবি: Getty Images/A.Hilabi
২০০৯: প্রথম নারী মন্ত্রী
২০০৯ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রথম নারী মন্ত্রী নিয়োগ করেন৷ নূরা আল কায়েজ নারী বিষয়ক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সে বছর সরকারে যোগ দেন৷
ছবি: Foreign and Commonwealth Office
২০১২: অলিম্পিকে প্রথম নারী অ্যাথলিট
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে অংশ নেন সৌদি নারীরা৷ তাঁদের মধ্যে সারাহ আত্তার নারীদের ৮০০ মিটার দৌড়ে লন্ডন অলিম্পিকের ট্র্যাকে নেমেছিলেন হিজাব পড়ে৷ আসর শুরুর আগে নারীদের অংশগ্রহণ করতে না দিলে সৌদি আরবকে অলিম্পিক থেকে বাদ দেয়ার কথা জানিয়েছিল আইওসি৷
ছবি: picture alliance/dpa/J.-G.Mabanglo
২০১৩: সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি
ঐ বছর সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি পান সৌদি নারীরা৷ তবে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এবং ইসলামি রীতিতে পুরো শরীর ঢেকে এবং কোনো পুরুষ আত্মীয়ের উপস্থিতিতে তা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
২০১৩: শুরায় প্রথম নারী
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাদশাহ আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের রক্ষণশীল কাউন্সিল ‘শুরা’য় প্রথমবারের মতো ৩০ জন নারীকে শপথ বাক্য পাঠ করান৷
ছবি: REUTERS/Saudi TV/Handout
২০১৫: ভোট দেয়া এবং নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার
২০১৫ সালে সৌদি আরবের পৌরসভা নির্বাচনে নারীরা প্রথমবারের মতো ভোট দেয়ার এবং নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান৷ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড নির্বাচনে নারীদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করেছিল ১৮৯৩ সালে, জার্মানিতে তা চালু হয় ১৯১৯ সালে৷ ২০১৫ সালে সৌদি আরবের ঐ নির্বাচনে ২০ জন নারী নির্বাচিত হয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Batrawy
২০১৭: সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জে প্রথম নারী
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারপার্সন হিসেবে সারাহ আল সুহাইমির নাম ঘোষণা করে আরেক ইতিহাস রচনা করে৷
ছবি: pictur- alliance/abaca/Balkis Press
২০১৮: গাড়ি চালানোর অনুমতি
গত ২৬শে সেপ্টেম্বর সৌদি আরব নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে৷ ২০১৮ সালের জুন মাসে এই আদেশ কার্যকর হয়েছে৷ এর ফলে নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না এবং স্বতন্ত্র লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা৷