বাংলাদেশেও ‘আমার জন্য মরো না'-র মতো গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে৷ গ্রন্থটা কলেবরে যে মহাকাব্যের রূপ নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ বাংলাদেশের নারীরা তো প্রতিনিয়তই ‘মার' খাচ্ছে!
বিজ্ঞাপন
‘ডোন্ট ডাই ফর মি', অর্থাৎ ‘আমার জন্য মরো না'৷ পেরুতে প্রকাশিত হয়েছে এই নামের একটি গ্রন্থ৷ এ খবরের সঙ্গে বার্তা সংস্থা এএফপি ২০০৫ সালের একটি সমীক্ষার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও-র সেই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ১০ বছর আগে পুরুষ সঙ্গীদের প্রহারের শিকার নারীর শতকরা হার পেরুতেই সবচেয়ে বেশি ছিল৷ সে বছর দক্ষিণ আমেরিকার ওই দেশে অন্তত ৬১ ভাগ নারীকে তাদের পুরুষ সঙ্গীরা শারীরিক নির্যাতন করে৷ সমীক্ষা শেষে ১০টি দেশের একটি তালিকা করেছিল ডাব্লিউএইচও৷ বাংলাদেশও ছিল সেই তালিকায় ৷ মেয়েদের পেটানোর মতো জঘন্য কাজে ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, জাপান, নামিবিয়া, সামোয়া, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো, থাইল্যান্ড এবং তাঞ্জানিয়ার পুরুষরাও ছিল পেরু আর বাংলাদেশের কতিপয় ‘পুরুষ' নামের কলঙ্কদের পাশে৷
গত দশ বছরে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থার কি এক্ষেত্রে খুব উন্নতি হয়েছে? হয়নি৷ মাত্র তিন মাস আগে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের তুলনায় পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা ১১ শতাংশ এবং পারিবারিক নির্যাতন ৪৪ শতাংশ বেড়েছে৷শুধু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে রচিত এ প্রতিবেদন অবশ্যই নারী নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়৷ সবাই নির্ভয়ে সব বলতে পারলে ওই ১১ এবং ৪৪ শতাংশ নিশ্চয়ই যথাক্রমে ২২ এবং ৬৫ বা তার বেশি হতো৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
এ অনুমানকে যাচাই করে নিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরেছিলাম৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এই তিন মাসের পরিসংখ্যান দেখেই আমার চক্ষু চড়কগাছ৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, শুধু পত্রিকার খবর অনুযায়ীই জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে ‘ঘরোয়া নির্যাতনে' মারা গেছেন ৯৯ জন নারী৷ এর মধ্যে স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে মৃত্যুর পথ ধরেছেন ১১জন, স্বামীর প্রহারে মারা গেছেন ৫৮ জন, স্বামীর পরিবারের লোকজনদের অত্যাচারে নিহত ১০ এবং নিজের আত্মীয়দের প্রহারে প্রাণ হারিয়েছেন ৪ জন নারী ৷ হত্যা ৯৯টি, কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র ৪৫টি৷
ওই সময়ে যৌতুকের বলী হয়েছেন ৪৩ জন নারী ৪৩ জনের মধ্যে ৩ জন স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকদের পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন, বাকি ৪০ জনের ক্ষেত্রে স্বজনদের অভিযোগ, যৌতুক আদায়ের উদ্দেশ্যে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁদের৷
গৃহস্থালি কাজ করতে গিয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, ফতোয়া দিয়ে জনসমক্ষে অপমান-নির্যাতন- এসব যোগ করলে তিন মাসের চিত্রটা কেমন হতে পারে?
ধরা যাক, স্বাধীনতার পরের ৪৩ বছরের একটা হিসেব টানা হলো৷ তারপর শুরু হলো পেরুর নারীদের মতো বাংলাদেশেও নির্যাতনে নিহত এবং আহতদের গল্প সংগ্রহের অভিযান৷ একেবারে শেষে চিঠি, ই-মেল, মোবাইল ফোনের মেসেজ বাছাই করে গ্রন্থ প্রকাশ৷ ২৫টি নাকি, ২৫ শ' হৃদয়স্পর্শী গল্প পাওয়া যাবে – সে বিতর্ক থাক৷ গ্রন্থের নাম, ‘আমার জন্য মরো না'-ই থাকবে? নাকি ‘‘পুরুষ, তুমি ‘মানুষ' থাকো' নামটা বেশি ভালো? প্রেমিক বা প্রেমিকা তো একে অন্যের মৃত্যু কামনা করতে পারেইনা৷ আবেগ-অনুভূতির পাশাপাশি মানুষ যদি বিবেকটাকেও বাঁচিয়ে না রাখে সে তাহলে কেমন প্রেমিক-প্রেমিকা, কেমনইবা মানুষ!