জার্মানির এসপিডি দল তাদের কংগ্রেসে প্রতিনিধিদের মধ্যে ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে, ম্যার্কেলের রক্ষণশীল দলের সঙ্গে মহাজোট গঠনের আলোচনা শুরু করবে কিনা৷ সিদ্ধান্ত ‘না' হলে চ্যান্সেলরকে আবারও নির্বাচন দিতে হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
জোট গঠনের আলোচনার পক্ষে যদি এসপিডি’র কংগ্রেস সমর্থন দেয় এবং জোটের আলোচনা যদি সফল হয়, তবে ইস্টার নাগাদ জার্মানিতে সরকার গঠন হতে পারে৷
জার্মানির অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক দল এসপিডিও সংকটে রয়েছে৷ দলটির অন্তত ৬০০ প্রতিনিধি বিভিন্ন রাজ্য থেকে বন শহরে এসে জড়ো হয়েছেন৷ তারাই সিদ্ধান্ত দেবেন, চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ এবং তাদের সহযোগী দল সিএসইউ-এর সাথে মহাজোট গঠনের চূড়ান্ত আলোচনা তারা শুরু করবে কিনা৷ এসপিডি'র সাবেক নেতা এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গাব্রিয়েল বুধবার বিল্ড পত্রিকাকে বলেছেন, ‘‘এটা বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে, রবিবার পুরো বিশ্বের চোখ থাকবে বন শহরের দিকে৷'' চ্যান্সেলর নিজেও নিশ্চয়ই বার্লিনে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে টিভি সেটের সামনেই বসে থাকবেন আজ পুরোটা সময়৷
এসপিডি'র ৬০০ প্রতিনিধিই নন, ভোটে সিদ্ধান্ত জানাবেন দলের ৪ লাখ ৪০ হাজার সদস্য৷ তাই প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়৷ বনের এই সিদ্ধান্ত কেবল জানাতে পারে সিদ্ধান্তটা কোন দিকে যেতে পারে৷ এসপিডি কি ‘গ্রোকো'কে 'না' বলবে? (সিডিইউ/সিএসইউমহাজোটকে জার্মান ভাষায় ‘গ্রোকো' নামে ডাকা হয়৷) তবে এসপিডি’র বেশিরভাগ সদস্যই ম্যার্কেলের দলের সাথে জোট গঠনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে৷ তাদের আশংকা এর ফলে দলের জনপ্রিয়তায় আরও ভাটা পড়বে, ভবিষ্যতে যা দলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে৷
বন এর বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে এসপিডি’র কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ ভেন্যুর সামনে সকাল থেকে ব্যানার হাতে বিক্ষোভ জানিয়েছেন দলের অনেক সদস্য৷ এদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ৷ প্রতিনিধিদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ জন তরুণ প্রতিনিধি রয়েছেন, যারা বিকেলে ভোট দেবেন৷
এসপিডি'র সিদ্ধান্ত ‘না' হলে ম্যার্কেলের হাতে থাকবে দু'টি বিকল্প৷ এক. সিডিইউ/সিএসইউ নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করা, অথবা নতুন নির্বাচনের ডাক দেয়া, যেটা হয়ত ম্যার্কেলের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে না৷
এসপিডির সংকট:
এসপিডিও কিন্তু ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷ বামপন্থি এই দলটির আত্মপরিচয় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ এ সপ্তাহে জনপ্রিয়তা জরিপে এসপিডির জনসমর্থন কমেছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরের চেয়েও যা ২ ভাগ কম৷ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল ছিল এবার এসপিডি'র৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসপিডি দলের নেতা মার্টিন শুলৎসও তাঁর দলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন৷ তাই রবিবারের ভোটে বেশিরভাগ প্রতিনিধিকেই তিনি পাশে পাবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এ সপ্তাহের একটি টকশো তে এসপিডি দলের পার্লামেন্টারি নেতা আন্দ্রেয়া নাহলেস জানিয়েছিলেন, এক তৃতীয়াংশ প্রতিনিধি তখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন৷ বার্লিনের এসপিডি প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে এবং তা হলো ‘না'৷
কী চায় জার্মানির এসপিডি দল?
ছোট শরিক হয়েও জার্মানির বিদায়ী মহাজোট সরকারে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে এসপিডি দল৷ তবে ভোটাররা তার স্বীকৃতি দেয়নি৷ আবার মহাজোটে যোগ দিলে অনেকগুলি শর্ত চাপাতে চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
‘আরও ইউরোপ’
বর্তমান সংকটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ব্রেক্সিটের পথে না গিয়ে ইইউ-কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চায় জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ ইউরোপীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরি, তরুণদের বেকারত্বের মোকাবিলা, কোম্পানিগুলির উপর অভিন্ন কর চাপানো এবং ‘কর ফাঁকির মরুদ্যান’ বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন দলের নেতা মার্টিন শুলৎস৷ ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই প্রাক্তন স্পিকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Florin
শ্রমিকদের আরও অধিকার
জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার বাড়াতে চিরকাল উদ্যোগ নিয়ে এসেছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের ফলে সেই ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ এবার বেতন ও মজুরি কাঠামো কার্যকর করা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানাচ্ছে এসপিডি৷ তাছাড়া যারা পার্ট টাইম বা খন্ডকালীন কাজ করছে, তাদের ফুল টাইম বা পূর্ণ কাজের কাঠামোয় ফিরে যাবার অধিকারের স্বীকৃতি চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/Ulrich Baumgarten
অবসর ভাতার আমূল পরিবর্তন
সমাজে সংহতির ভিত্তিতে জার্মানির অবসর ভাতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ বিশেষ করে সারা জীবন কাজ করেও শেষ বয়সে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় এসপিডি৷ অতএব সংহতির স্বার্থে অবসর ভাতার বিচ্ছিন্ন সব কাঠামোগুলিকে একত্র করার চেষ্টা চালাতে চায় তারা৷ অত্যন্ত জটিল এই ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন যে কঠিন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য তেমন সংশয় নেই৷
ছবি: picture-alliance/S. Gollnow
বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অংশই সরকারি ভরতুকিতে চলে৷ তবে অবকাঠামোর কিছু দুর্বলতার ফলে সমস্যা রয়েছে৷ বিশেষ করে শিক্ষা রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারে থাকায় এ ক্ষেত্রে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন৷ এসপিডি দলের দাবি, সারা দেশে বিনামূল্যে কিন্ডারগার্টেন ও সেখানে সারাদিন বাচ্চা রাখার সুযোগকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার সংস্কার
বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু রয়েছে৷ ডাক্তারখানা ও হাসপাতালে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাকারীদের বিশেষ খাতির করা হয়, অন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়৷ এই বিভাজন ঘুঁচিয়ে সবাইকে নিয়ে এক ‘নাগরিক স্বাস্থবিমা’ চালু করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রীরা৷ তবে এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করছে বেশ কিছু মহল৷ তাদের আশঙ্কা, এর ফলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মানের ক্ষতি হবে৷
ছবি: Colourbox
শরণার্থী নীতি
২০১৫ সালে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ঢলের কারণে জার্মানির রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর উদার মনোভাবের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এসপিডি গোটা অভিবাসন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে, যাতে আইনি পথে বিদেশিরা জার্মানিতে এসে কাজের সুযোগ পায়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সঙ্কুচিত করার বিরোধী এই দল৷ আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধসীমাও মানতে নারাজ তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সন্ত্রাসী হামলা ও অপরাধ দমন করতে প্রায়ই হিমশিম খায় জার্মানির পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ ফলে মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়৷ এই সমস্যার মোকাবিলা করতে এসপিডি দল আরও পুলিশকর্মী নিয়োগের দাবি জানাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ করার জোরালো উদ্যোগ চায় তারা৷ তাদের মতে, দাগী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থায় আরও দক্ষতার ছাপ আনতে হবে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/B. Marks
পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে এককালে জার্মানি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে৷ বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও এসেছে৷ কিন্তু কয়লার লাগাতার ব্যবহার, ডিজেল গাড়ি নিয়ে বিতর্কের মতো কারণে এ ক্ষেত্রে জার্মানির ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাচ্ছে৷ এমন প্রেক্ষাপটে এসপিডি বিকল্প জ্বালানির আরও ব্যবহারের উপর জোর দিতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য বাস্তব সমস্যা৷ এই তালিকায় জার্মানির অবস্থান ভালো নয়৷ একাধিক সরকার এই বৈষম্য দূর করতে শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে৷ এবার এসপিডি দল চায়, আলাপ-আলোচনার বদলে আইন করে তাদের এই বৈষম্য দূর করতে বাধ্য করা হোক৷