বাংলাদেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বা এর মধ্যে হয়েও গেছে৷ এখানে সামাজ ও রাষ্ট্রের মোরাল ও এথিকস দেখার ও মেনটেইন করার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর৷
বিজ্ঞাপন
তারা আদর করে বুঝাবেন, না বুঝলে চোখ রাঙাবেন, তাতে কাজ না হলে গারদে রেখে দেবেন বা তার সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধারে যাবেন৷
আমরাও মোটামুটিভাবে তাই চাই৷ কারণ, আমাদের চাওয়া এক্ষুণি পূরণ করতে হবে৷ তার ফলে বেল আর নোবেল সবক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকাই উপসংহার৷ নোবেলের কথাই ধরা যাক৷
নোবেল কেমন গান করেন আমি জানি না৷ আমি কখনো শুনি নাই তাকে৷ রিয়েলিটি টিভি থেকে আসা নায়ক গায়কদের নিয়ে আমার আগ্রহ কম৷ এটা এক ধরনের পুরনো মানসিকতা বা একগুঁয়েমি ধরে নিতে পারেন৷ কিন্তু মোদ্দা এই যে, আমি নোবেলের গান শুনি নাই, শোনার আগ্রহও হয় নাই৷
সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করি বলে কে কী ভাবছেন তার দিকে খেয়াল রাখতে হয় আমার৷ কয়েকদিন ধরেই দেখছি মাঈনুল আহসান নোবেলকে নিয়ে আমার ফেসবুক বন্ধুরা খুব উত্তেজিত৷ তার অপরাধের তালিকার দিকে নজর দেয়া যাক৷ তিনি নাকি লেজেন্ডদের শেখাবেন কীভাবে হিট গান করতে হয় এমন একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন৷ এতে করে আমাদের সবার লেজেন্ড অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে৷ তিনি ও ইউটিউবার তাহসিনেশন পরষ্পরকে আক্রমণ ও বিকৃতি করেছেন৷
নোবেলকে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক স্ট্যাটাস থেকে বিরত থাকতে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম তার ফেসবুকে একটি সতর্কতামূলক স্ট্যাটাস দেন৷ কিন্তু নোবেলের আপত্তিকর স্ট্যাটাসগুলো রয়ে গেলে তা র্যাব ২ এর নজরে আসে৷ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনির জামান তাকে কার্যালয়ে ডেকে নেন৷ সেখানে যাওয়ার পরে তিনি তার এসব কাজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ক্ষমা চেয়ে ভিডিও বার্তা দেন৷
এর আগেও র্যাব, পুলিশ, ডিবি এই ধরনের সমাজ সংস্কারমূলক কাজ করেছে৷ কারো ভিডিওতে আপত্তিকর কোনো কিছু থাকলে বা কেউ সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভাঙলে তাকে ডেকে নিয়ে উপদেশ, নির্দেশ দিয়েছেন৷ যাদের উপদেশ দেওয়া হয় তারাও সঙ্গে সঙ্গে তার কৃতকর্মের ভুল বুঝতেও পারছে৷ আমাদের অনেকে খুশি হচ্ছি৷
র্যাব বা পুলিশরাই যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মাতবর আর পঞ্চায়েত হতে যাচ্ছেন, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ রাখা উচিত না৷ রাষ্ট্রকাঠামোর আইন ও বিচারের উপর আমাদের আস্থার অভাব বা অনাস্থা এর একটি কারণ৷ তার চেয়েও বড় কারণ হলো আমাদের নিজেদের বিচারের উপর আমাদের সাংঘাতিক আস্থা৷
আমরা এক ফেসবুককে আঙুলের আওতায় আনতে পেরে কাউকে জুতার মালা দেওয়ার প্রস্তাব করি, কাউকে বাস্তব অবাস্তব আরো নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করি৷ সমাজের শিক্ষিত মানুষ বলে যারা পরিচিত, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও দাবি করেন, অমুক অপরাধের একমাত্র শাস্তি হলো তাকে নিয়ে র্যাব বা পুলিশের অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া৷
করজোড় নিবেদন, কিছু ভালো না লাগলে তা বর্জন করুন৷ যার যার দায়িত্ব তার তারই তা পালন করা উচিত৷ বাঁশের কাজ বা বাঁশির কাজ আলাদা৷ আর যদি মনে করেন, পুলিশি রাষ্ট্রই ভালো তবে তাই হোক৷ নিজেরাও পুলিশ, জজ হোন আর না পারলে আমাদের কথা শোনার জন্য আমাদের হয়ে যথাবিহিত ব্যবস্থা করার জন্য র্যাব বা পুলিশ তো আছেই৷
রাষ্ট্রের দমন কৌশল
বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা বিরুদ্ধমত দমন করেছে৷ কখনও আইন, কখনও প্রশাসন, কখনও সহযোগী সংগঠনের পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন৷
ছবি: Sony Ramany/AFP
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি
সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এরশাদের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করে৷ এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও৷ ২০০৬ সালে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গণবিক্ষোভে ২০ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/H. U. Rashid Swapan
মিছিল-সমাবেশে বাধা
নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা দেয়৷ চলে পুলিশি হামলা, নির্যাতনের ঘটনা৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে৷ শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় নাগরিক সমাজের প্রতিবাদেও বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ছবি: bdnews24.com
গুম কিংবা নিখোঁজ
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
মামলার হয়রানি
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
ছবি: bdnews24.com
পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছে বিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে এমন পেশিশক্তির ব্যবহার আরও প্রকট হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
নিষ্পেষণমূলক আইন
ভিন্নমত দমনে আশ্রয় নেয়া হয় আইনেরও৷ ২০১৫ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ব্লগার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে৷ সেটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলে সেখানেও একই ধরনের বিভিন্ন ধারা রাখা হয়৷ এই আইনে আটক হয়ে জেলখানায় বিনা বিচারে মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
গণমাধ্যমের উপর চাপ
বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম থাকলেও তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয় সরকার৷ মালিকানা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই এখন সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালের ২৯ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ঐ বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি বড় অর্জন৷’’
ছবি: picture-alliance/chromorange/C. Ohde
ফোনে আড়িপাতা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন মানুষের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে৷ ইউটিউব বা গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা৷
ছবি: imago/avanti
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বিরোধী দলসহ নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলা এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে৷