শুধু টেকনাফের বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাসই নন, বিভিন্ন থানার আরো অনেক ওসির বিরুদ্ধে ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্যের’ অভিযোগ আছে৷
বিজ্ঞাপন
সাবেক একজন পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘‘কিছু পুলিশের মাথায় এখন শুধু টাকা, তারা যেকোনো উপায়ে অবৈধ টাকা আয় করতে চায়৷’’
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ক্রসফায়ারকে পুলিশের কেউ কেউ রীতিমত ‘বাণিজ্যে’ পরিণত করেছেন, টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন৷
গত ৩১ শে জুলাই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা ‘ক্রসফায়ার' বলে দাবি করা হয়েছিল৷ এই ঘটনার পর টেকনাফে থানার সামনে জড়ো হয়ে আরো অনেক ভুক্তভোগী সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷ টাকা না দেয়ায় স্বজনদের ক্রসফয়ারের নামে মেরে ফেলা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন৷ আবার ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও আসছে৷
একইভাবে ঢাকার কোতোয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা হয়েছে ১৩ আগস্ট৷ মামলার বাদী কেরানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোহেল মীরের অভিযোগ, গত দুই আগস্ট ঢাকার ওয়াইজ ঘাট থেকে তাকে আটক করা হয়৷ এরপর তার পকেটে থাকা দুই হাজার ৯০০ টাকা নিয়ে নেয় পুলিশ সদস্যরা৷ আরো টাকা দিতে না পারায় তাকে ইয়াবা মামলা দেয়ার কথা বলে কোতয়ালি থানায় নিয়ে যায়৷ থানায় নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশ দেড় লাখ টাকা নিয়ে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে কোর্টে চালান করে বলে অভিযোগ তার৷
নূর খান
ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ১৩ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানা পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে৷ হারুন মিয়া নামে একজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়৷ এ নিয়ে কথা বললে ওই থানার সেকেন্ড অফিসার নিতাই চন্দ্র দাস তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে৷
রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধেও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ১২ আগস্ট ঢাকার আদালতে মামলা করেছেন গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যবসায়ী৷ আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে৷
সিনহা হত্যার পর আইন ও শালিশ কেন্দ্র জানায়, চলতি বছরেই এ পর্যন্ত ১৮৪ জন ‘বন্দুকযুদ্ধের' শিকার হয়েছেন৷ গত বছর এই সংখ্যা ছিলো ৩৬৭ জন৷ ২০১৮ সালে মারা গেছেন ৪২১ জন৷
দুই বছর আগে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ২০১৮ সালর ২৬ মে টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা একরামুল হককে হত্যার পরও ক্রসফায়ার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল৷ একরামের বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা বা মাদক ব্যবসার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি তখন৷ সিনহা হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন উঠছে ক্রসফায়ার কি আদৌ বন্ধ হবে? মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘সিনহা হত্যাই প্রথম বা শেষ নয়৷ গত ১৫ বছর ধরে এই ক্রসফায়ার চলছে৷ তিন হাজারের বেশি মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷ আমাদের দাবি অবিলম্বে ক্রসফায়ার বন্ধ করা হোক৷ আর এ পর্যন্ত যত ক্রসফায়ার হয়েছে সবগুলো তদন্ত করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে দায়ীদের শাস্তির আওয়তায় আনা হোক৷’’
সৈয়দ বজলুল করিম
শুধু ক্রসফায়ার নয়, আরেক আতঙ্কের নাম নিখোঁজ-গুম হয়ে যাওয়া৷ দেড়ুযুগ সময়ে যার শিকার প্রায় সাতশ বলে জানান তিনি৷ নূর খান অভিযোগ করেন, ‘‘প্রথম দিকে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ক্রসফায়ারকে সংক্ষিপ্ত পথ হিসেবে বেছে নিলেও এটাকে এখন তাদের অর্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷’’
পুলিশের সাবেক এআইজি এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, ‘‘কিছু পুলিশ সদস্য বিশেষ করে ওসিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন৷ পুলিশের একাংশ এখন যেকোনো উপায়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত৷ ফলে তারা মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছে৷ আর এই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ক্রসফায়ারও ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে৷ এই ধরনের ক্রসফায়ার কোনোভাবেই আমি সমর্থন করি না৷’’
তার মতে, ‘‘এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায় নিতে হবে৷ বিশেষ করে পুলিশ সুপারদের দায় সবচেয়ে বেশি৷ কারণ তারাই ওসিদের সুপারভাইজিং অফিসার৷ তাদের অগোচরে পুলিশে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে কিভাবে!’’
এই দুই জনই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পুলিশে অতি দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন৷
এইসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কোন বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি৷
গ্রেপ্তারকৃতের সঙ্গে আচরণ: আইন যা বলে, বাস্তবে যা হয়
গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তা বলা রয়েছে বিভিন্ন আইন আর পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকাতেও৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তা মানছে না৷ আইনের বরখেলাপ ঘটছে গণমাধ্যমের আচরণ ও সংবাদ পরিবেশনেও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
কখন অপরাধী?
আইন অনুযায়ী আদালতে একজন ব্যক্তি অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তারের পর তাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করে৷ গ্রেপ্তারকৃতের শরীরে ‘আমি জঙ্গি’, ‘চোর’, ‘মাদক ব্যবসায়ী’, ‘ইয়াবা কারবারি’, ‘ধর্ষক’-এমন পরিচয় ঝুলিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়৷ গণমাধ্যমেও তাদের সেই ছবি, পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
আদালতের আগে গণমাধ্যমে
২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া কোনো ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করার নির্দেশ দেয়৷ বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মিন্নিকে দেওয়া জামিন সংক্রান্ত রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধের তদন্ত চলার সময় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার আগেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অ-অনুমোদনযোগ্য৷
ছবি: bdnews24
মিডিয়া ট্রায়াল
বিচারের আগেই কোন ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা মিডিয়া ট্রায়াল নামে পরিচিত৷ সম্প্রতি এমন মিডিয়া ট্রায়ালের ঘটনা বাড়ছে৷ যাচাই, বাছাই ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে৷ অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে এমন প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সংশ্লিষ্ট আইন এবং সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার নীতিমালাও অনুসরণ করা হচ্ছে না৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
হাতকড়া ও রশির ব্যবহার
পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত আসামি বা বিচারাধীন বন্দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর সময় পলায়ন বন্ধের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কঠোর ব্যবস্থা নেয় উচিত নয়৷ হাতকড়া ও দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর৷ অথচ নিখোঁজের ৫৪ দিন পর ২০২০ সালের মে মাসে সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়৷ সেই ছবি সমালোচনার জন্ম দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
শিশুদের সঙ্গে আচরণ
শিশু আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী, শিশুকে কোনোমতেই হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাবে না৷ কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এর ব্যাত্যয় ঘটায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ ২০১৯ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে দুই শিশুকে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করা হয়৷ ঢাকার আদালতে এমন একাধিক ঘটনার খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Weigel
শিশুর ছবি
শিশু আইন ২০১৩-এর ৮১ ধারায় কোনো মামলায় বা অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনায় কোনো শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ বলা হয়েছে, বিচারাধীন কোনো মামলায় কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়৷ কিন্তু আদালতে শিশুদের হাজিরার শনাক্তযোগ্য ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
যেন পরিচয় প্রকাশ না পায়
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ রয়েছে৷ বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধের শিকার নারী, শিশুর সংবাদ এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম ঘটছে৷ ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, পরিচয় প্রকাশ করার ঘটনা ঘটেছে অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone USA Falkenberg
রিমান্ড মানে কি নির্যাতন?
কোনো মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে হেফাজতে নিতে পারে৷ কিন্তু শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করার এখতিয়ার নেই৷ এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনাও রয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে রিমান্ড আর নির্যাতন অনেকটা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে৷ অনেক সময়ই রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়৷ পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও আছে৷