নিখোঁজ হওয়ার সাড়ে তিন মাসের মাথায় ব্রিটেন প্রবাসী বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান মুজিব উদ্ধার হওয়ার পর, ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন৷ পুলিশ পাহারাও রয়েছে সেখানে৷ সোমবার তিনি তাঁর শ্যালকের বাসায় ফিরে আসেন৷
বিজ্ঞাপন
মুজিবুর রহমানের শ্যালক আনোয়ার হোসেনের বাসা গুলশানে৷ মুজিব ও তাঁর গাড়ি চালক মো. রেজাউল হক সোহেল ছাড়া পেয়ে নিজেরাই সেই বাসায় যান৷ আনোয়ার হোসেন বলেন, সোমবারই তিনি দেশের বাইরে থেকে ঢাকায় ফিরেছেন৷ তিনি দু'জনের উদ্ধার হয়েছে খবর পেয়ে বাসায় গিয়ে দেখেন যে, মুজিব ও সোহেল বিছানায় শুয়ে আছেন৷ তাঁদের এরপর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে ফিরে আসার খবর পুলিশকে জানানো হয়৷ এরপর রাতে গুলশান জোনের পুলিশের একজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে বেশ কিছু সাদা পোশাকের পুলিশ ইউনাইটেড হাসপাতালে যান৷
আনোয়ার হোসেন জানান, প্রাথমিক আলাপচারিতায় মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন যে, গত ৪ঠা মে বিকেলে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট ফেরার পথে সিলেট শহরতলীর টুকের বাজার এলাকায় তাঁকে বহনকারী গাড়িটির গতিরোধ করে একটি মাইক্রোবাস৷ ঐ গাড়িতে বসা ছিল ৮ থেকে ১০ জন লোক৷ তারা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরিচয় দেয়৷ প্রথমে তারা গাড়ির চালক সোহেলের লাইসেন্স দেখতে চায়৷ এরপর দু'জনকে গাড়ি থেকে নামতে বলে৷ গাড়ি থেকে নামার পর পরই পাশেরই মাইক্রোবাসে উঠতে বলে মুজিব ও গাড়ি চালক সোহেলকে৷ এ সময় মুজিব ও সোহেল ধস্তাধস্তির চেষ্টা করলে আগন্তুকরা অস্ত্র বের করে তাঁদের মাথায় ঠেকায় ও গুলি করার হুমকি দিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়৷ গাড়িতে উঠার পর পরই মুজিব ও সোহেলের নাকে কিছু একটা স্প্রে করা হয়৷ এরপর আর কোনো কিছু বলতে পারেননি তিনি৷
গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার লুত্ফুর কবির সাংবাদিকদের জানান, বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমানকে পুলিশি নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷ তিনি সুস্থ হলে দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস কোথায় ছিলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করেছিল – এ ব্যাপারে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷
ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্লিনিকাল কো-অর্ডিনেটর মাহিন আহমেদ বলেন, হাসপাতালে মুজিবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে৷ চিকিত্সকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন৷ তিনি জানান, মুজিব দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছিলেন৷ তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও কিছুটা কম৷ তবে তাঁর কথাবার্তা স্বাভাবিক৷
ব্রিটেন বিএনপির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান ও তাঁর গাড়িচালক রেজাউল হক সোহেল গত ৪ঠা মে ‘হত্যা-গুম'-এর প্রতিবাদে সুনামগঞ্জে বিএনপির এক সমাবেশে যোগ দিয়ে সিলেটে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন৷
৬ই মে মুজিবের ভাগনি জামাতা অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন৷ ঐ দিন দুপুরে জেলা বিএনপি মুজিবের সন্ধান চেয়ে শহরের লন্ডন প্লাজার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে৷ ৭ই মে মুজিব ও তাঁর গাড়ি চালক সোহেলের সন্ধান দাবিতে সুনামগঞ্জ শহরে মানববন্ধন এবং ৮ই মে সুনামগঞ্জ জেলায় আধাবেলা হরতাল পালন করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন৷ সাধারণ ডায়েরিকে অভিযোগ হিসেবে নিয়ে পুলিশ ঘটনার পর সিলেট শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে আকবর চৌধুরী, জিহাদ ও তারেক নামে তিন যুবককে আটক করে৷ অপরদিকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কসবা গ্রাম থেকে মাহমুদ নামে অপর এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ৷ মুজিব নিখোঁজের ঘটনায় আটককৃতরা বর্তমানে জামিনে আছেন বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানে আলম খান৷
গাড়ি চালক বাড়ি ফেরেনি
নিখোঁজ হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর উদ্ধার হলেও মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বাড়ি ফেরেননি মুজিবুর রহমানের গাড়ির চালক মো. রেজাউল হক সোহেল৷ পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়নি৷ খোঁজ না পেয়ে তাঁর পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে৷
সোহেলের বাবা ওয়াহিদুল হক জানান, সোমবার রাত নয়টায় দিকে টেলিভিশনে মুজিব ও রেজাউলের খোঁজ পাওয়ার সংবাদ দেখেন তিনি৷ এরপর তিনি মুজিবের ভাতিজা আবুল হোসেনের কাছে ফোন করেন৷ তখন আবুল হোসেন তাঁকে জানান, সোহেলকে সুনামগঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ মুজিবের শ্যালক আনোয়ার হোসেন জানান, সোমবার রাতেই এক হাজার টাকা দিয়ে সোহেলকে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জে যেতে বলা হয়েছে৷ তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সে সুনামগঞ্জ যায়নি৷ সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানান, পুলিশও গাড়িচালক সোহেলকে খুঁজছে৷
গুলশানের বাসভবনে ‘অবরুদ্ধ’ খালেদা জিয়া
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশানের বাসভবনে কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছে৷ রবিবার তিনি পুলিশের বাধার কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি থেকে বেরোনোর চেষ্টা
‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’য় অংশ নিতে রবিবার স্থানীয় সময় দুপুর তিনটার দিকে গুলশানের বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া৷ কিন্তু তাঁর পথরোধ করতে বাড়ির গেটে মানব দেয়াল তৈরি করে পুলিশ এবং ব়্যাবের সদস্যরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
আটকে ছিলেন গেটে
পুলিশ এবং ব়্যাব সদস্যদের বাধার মুখে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন খালেদা জিয়া৷ এরপর এক পর্যায়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
গাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী৷ এসময় তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷ উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, ‘‘দেশ আজ কোথায় যাচ্ছে? এরা সবাই গোপালগঞ্জের৷ গোপালগঞ্জের নামই বদলে যাবে৷’’ দৈনিক প্রথম আলো খালেদার এই বক্তব্য প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সোমবারও চলবে কর্মসূচি
নিরাপত্তা বাহিনীর বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া৷ তবে তিনি বাড়ির মধ্যে ফিরে যাবার আগে উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘‘এই সরকার জালেম এবং অগণতান্ত্রিক৷ এই সরকারের পতন হবেই৷’’ এসময় তিনি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ সোমবারও চলবে বলে ঘোষণা দেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বালুভর্তি ট্রাকের ব্যারিকেড
খালেদা জিয়ার বাড়ির চারপাশে গত কয়েকদিন ধরেই পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল৷ শনিবার তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় সাধারণ ব্যারিকেডের পাশাপাশি বালুভর্তি ট্রাকও যোগ করা হয়৷ কয়েকটি ট্রাক এমনভাবে রাখা হয়, যাতে খালেদার গাড়ি বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে বের হতে না পারে৷ আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশিদ স্বপন জানান, খালেদা জিয়াকে কার্যত গুলশানের বাড়িতে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশের বক্তব্য
খালেদা জিয়াকে বাড়ির বাইরে যেতে না দেয়া প্রসঙ্গে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নয়াপল্টনে কোনো জমায়েত বা সমাবেশের অনুমতি নেই৷ তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীকে সেখানে যেতে দেয়া হবে না৷ আর তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টিও পুলিশের দেখার আছে৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
প্রাণহানি
এদিকে, ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’কে ঘিরে সংঘর্ষ এবং বিস্ফোরণে ঢাকায় কমপক্ষে দুই ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন৷ রবিবার সকাল এগারোটার দিকে ঢাকার মালিবাগে পুলিশ আর জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারান মনসুর আলী৷ অন্যদিকে, কমলাপুরে তল্লাশির সময় বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন নিরাপত্তাকর্মী আবুল কাশেম৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
সুপ্রিমকোর্টে তাণ্ডব
এদিকে, ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’য় যোগ দিতে সুপ্রিমকোর্টের বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কোর্টের মূল গেট দিয়ে মিছিল করে নয়াপল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের জল কামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আটকে দেয়৷ এরপর তারা ভিতরে গিয়ে পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল ছোড়ে৷ এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একদল সমর্থক সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ঢুকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়৷ সেখানে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
বিরল সংঘর্ষ
বলাবাহুল্য, সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বাইরে থেকে কোন দলের নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয়নি৷ সেক্ষেত্রে রবিবার আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আদালত চত্বরে প্রবেশ করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াটা বিরল ঘটনা বলে অবিহিত করেন আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি৷
ছবি: Reuters
চুপচাপ নয়াপল্টন
‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচির আওতায় গোটা দেশ থেকে সক্ষম নেতাকর্মীদের ২৯ ডিসেম্বর, রবিবার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে হাজির হওয়ার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া৷ কিন্তু রবিবার বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়ো হতে পারেনি৷ কিছু নেতাকর্মী কার্যালয়ের সামনে যেতে চাইলে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ ফলে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দৃশ্যত পুলিশ এবং সাংবাদিক ছাড়া কেউ ছিল না৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচন
উল্লেখ্য, আগামী পাঁচ জানুয়ারি বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এই নির্বাচন বর্জন করায় এবার ১৫৪টি আসনে ভোটাভুটির দরকার হচ্ছে না৷ এসব আসনে একজন করে প্রার্থী রয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার ঘোষণা দিয়েছে৷