তাদের উপর পুলিশের লাথি ও লাঠি নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। শুরু রিলে অনশন, বিক্ষোভ মিছিল। প্রতিবাদ বিরোধীদের।
যোগ্যঃঅযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশের দাবিতে ও পুলিশের লাথি ও লাঠির প্রতিবাদে শিক্ষকদের মিছিল। ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজ্ঞাপন
চাকরিহারা শিক্ষকদের গায়ে যেভাবে পুলিশ হাত দিয়েছে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে। চাকরিহারা শিক্ষকরা একদিকে যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশন(এসএসসি)-র অফিসের বাইরে অবস্থান ও রিলে অনশন শুরু করেছেন, তেমনই তারা শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেন। সেই মিছিলে যোগ দেন বর্তমান শিক্ষকরা। যোগ দেন সাধারণ মানুষও। তাদের প্রধান দাবি, যোগ্য ও অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
চাকরিহারা শিক্ষকদের লাথি ও লাঠির পর পুলিশ দুইটি এফআইআর করেছে। সেখানে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর ও পুলিশকে মারার জন্য চাকরিহারা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
লাথি খাওয়া সেই শিক্ষক যা বললেন
বুধবার কসবার ডিআই অফিসের বাইরে যে চাকরিহারা শিক্ষককে লাথি মারা হয়েছিল, তার নাম অমিত রঞ্জন ভুঁইঞা। তিনি কেওড়াখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক। বৃহস্পতিবার তিনি শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলে অংশ নেন। তিনি জানিয়েছেন, ''আমাকে যে লাথি মারা হয়েছে, সেই লাথি সমগ্র শিক্ষক সমাজের উপর এসে পড়েছে। এই লাথি সব বাঙালির উপর লাথি, মানুষের উপর লাথি।''
অমিত রঞ্জন বলেছেন, ''আমাদের কাছে খবর ছিল ডিআই অফিস আমাদের বেতন আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা সেই বিষয়টি নিয়ে জানতে গেছিলাম। সেটার জন্য লাঠি ও লাথি খেয়েছি।''
নৈহাটি থেকে আসা এক শিক্ষিকা জানিয়েছেন, ''শিক্ষকদের পেটে লাথি মারার পর এবার গায়েও লাথি মারা হচ্ছে। ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। আমরা শিক্ষা দিই। সেই শিক্ষকদের গায়ে লাথি পড়লো। মেনে নিতে পারছি না বলে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।''
অমিত রঞ্জন ভুঁইঞার দাবি, পুলিশের লাথি পুরো শিক্ষক সমাজের উপর এসে পড়েছে। ছবি: Satyajit Shaw/DW
এসএসসি অফিসের সামনে অনশন
বুধবার রাত থেকেই এসএসসি অফিসের সামনে অবস্থানে বসেন চাকরিহারা শিক্ষকদের একটা অংশ। সারা রাত ধরে অবস্থানের পর সকাল এগারোটা থেকে তারা রিলে অনশন শুরু করেন। তাদের দাবি, যোগ্য কারা সেই তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
অনশনকারী শিক্ষক পঙ্কজ রায় বলেছেন, ''আর কোনো রাস্তা নেই। এটাই একমাত্র পথ। যোগ্য ও অযোগ্যদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা দুর্নীতির মধ্যে যোগ্যতার প্রমাণ করেছি। কে সেটা বলবে। সরকার পুরোটা করেছে। তাদের যোগ্য ও অযোগ্যকে প্রভেদ করতে হবে।''
শিক্ষকদের জন্য জলের বোতল নিয়ে একজন নারী এসেছিলেন সেখানে। তিনি বলেছেন, ''একটা চাকরি পাওয়া যে কতটা কঠিন, তা আমি জানি। যোগ্য প্রার্থী বলে এরা চাকরি পেয়েছিলেন। যোগ্য ও অযোগ্যদের মধ্যে প্রভেদ করতে হবে। এত অন্যায় মেনে নেয়া যাচ্ছে না।''
অনশনরত শিক্ষকদের কাছে গিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সাবেক সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেতা ও বিজেপি নেতা ইন্দ্রনীল ঘোষ। তারা সেখানে গিয়ে চাকরিহারাদের সঙ্গে কথা বলেন।
শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিক্ষোভ-মিছিল
চাকরিহারা শিক্ষকদের ডাকে শিয়ালদহ থেকে মিছিল শুরু হলো। সেই মিছিলে চাকরিহারাদের পাশাপাশি স্থায়ী শিক্ষক, পড়ুয়া ও সাধারণ মানুষও যোগ দিলো। মিছিলে ছিলেন অভিনেতারাও।
কোন পথে যাওয়া হবে তা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর মিছিল শুরু হলো। তারপর সেই দীর্ঘ মিছিল গেলো ধর্মতলার দিকে। পুলিশি অত্যাচার নিয়ে, যোগ্য-অযোগ্য আলাদা তালিকা প্রকাশের দাবিতে মিছিল চললো।
যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশের দাবি তুলে রিলে অনশনে চাকরিহারা শিক্ষকরা। ছবি: Satyajit Shaw/DW
ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে গিয়ে মিছিলে যোগ দেয়া চাকরিহারারা রাস্তায় বসে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ''আমাদের নির্মমভাবে পুলিশ মেরেছে। আমরা অভিযোগ জানাতে গেছিলাম। আমরা চাই যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।''
পুলিশি তদন্ত
চাকরিহারাদের উপর লাঠি ও লাঠি নিয়ে বিশেষ তদন্তের নির্দেশ। তবে সেই তদন্ত পুলিশই করবে। কেন লাথি মারা হলো, লাঠি চালানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কিনা, সেটাও পুলিশ কর্তাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিরোদীদের বিক্ষোভ
চাকরিহারাদের উপর পুলিশের লাথি ও লাঠি মারার প্রতিবাদে বিজেপি যুব মোর্চার কর্মীরা বিধাননগরে এসএসসি অফিরের কাছে বিক্ষোভ দেখায়। তারা মিছিল করে। স্লোগান দেয়। তারপর পথ অবরোধ করে। পুলিশ তাদের আটক করে বাসে তুলে নিয়ে যায়।
সিপিএম ও কংগ্রেসও কসবার ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল।
চাকরি দুর্নীতি : যোগ্যদের পাশাপাশি অযোগ্যদেরও পাশে থাকতে চেয়ে তোপের মুখে মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যোগ্যদের চাকরির বিষয়টির ফয়সালা করে অযোগ্যদের বিষয়টিও দেখবেন। কিন্তু ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ মানতে নারাজ যোগ্যরা৷ অযোগ্যদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েও তোপের মুখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী...
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সময় চাইলো এসএসসি
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছিল, যেহেতু যোগ্য ও অযোগ্যর মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, তাই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হবে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে করা আবেদনে বলেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের শেষপর্যন্ত যোগ্যদের চাকরি করতে দেয়া হোক। এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মমতা যা বললেন
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের একাংশকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''কারো চাকরি যাবে না। আগে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্য়া চাইবে। সুপ্রিম কোর্টের নেতিবাচক উত্তর হলে সরকার যোগ্যদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবে। দুই মাসের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবো।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আপনারা কি এখনো বরখাস্তের নোটিস পেয়েছেন? (না পেয়ে থাকলে) চাকরি করুন না! স্বেচ্ছায় তো সকলেই কাজ করতে পারেন।’’ তিনি আরো বলেন, ''আপনাদের সরকার বরখাস্ত করেনি। আপনারা স্কুলে যান। কাজ করুন।'' কিন্তু স্বেচ্ছায় কাজ করলে বেতন পাওয়া যাবে কিনা, স্বেচ্ছায় কাজ করলে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষকদের মতো অল্প বেতন দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ
মুখ্যমন্ত্রীর স্বেচ্ছাশ্রমের বিষয়টি উপস্থিত চাকরিহারা শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, এভাবে হয় না, স্বেচ্ছাশ্রম বিষয়টির ব্যাখ্যা চাই। তবে তারা স্কুলে ফিরতে চান। তারা বলেন, বেতনসহ চাকরি রাখা হলে তারা স্কুলে ফিরবেন। তবে তারা চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতে চান না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের চাকরির প্রসঙ্গে মমতা
এ বিষয়ে মমতা বলেন, ''অযোগ্যদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করবো। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে আমার কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু অযোগ্য কাকে বলেছে, কেন বলেছে, কোন এজেন্সি বলেছে- সে সব দেখবো। নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য এবং অযোগ্যদের মধ্যে গন্ডগোল বাঁধাবেন না। মানুষকে শিক্ষা দিন। শিক্ষিত করুন। কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য তা আদালত বলেনি। ২০২২ থেকে খেলা শুরু করেছে। আমি জেনে-শুনে কারো চাকরি খাইনি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ
অযোগ্যদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার প্রতিবাদ করেন সভায় উপস্থিত চাকরি হারানো শিক্ষকরা। তারা বলেন, অযোগ্যদের চাকরি দেয়া যাবে না। তাদের প্রশ্ন- যোগ্যদের তালিকা তিনি কি সুপ্রিম কোর্টে দেবেন? সুপ্রিম কোর্ট তো তালিকা দেবে না। দেবে এসএসসি। সিবিআই রিপোর্ট মানলে যোগ্য ও অযোগ্যদের তো আগেই আলাদা করা যেতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চাকরিহারাদের দাবি
চাকরিহারা শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, রাজ্য সরকার ও এসএসসির জন্য এখন তাদের এই অবস্থা। তারা যোগ্য ও অযোগ্য আলাদা করেনি। চাকরি হারানো যোগ্য শিক্ষকরা মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী সব গোলমাল পাকিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিকাশ ভট্টাচার্য বনাম মমতা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''সিপিএমের কাছে প্রশ্ন করছি, কেন বিকাশ ভট্টাচার্য সব চাকরি বাতিল করালেন? তাকে আইসোলেট করুন।'' এর জবাবে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ''তিনি দুর্নীতি করেছেন। সকলে পেটাবে। মারের হাত থেকে বাঁচতে এসব বলছেন। তিনি বারবার যোগ্য অযোগ্য বলছেন। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে তো বললেন না। রায়ের পর লম্ফঝম্প করছেন।''
ছবি: Srijit Roy
বিরোধী নেতার বক্তব্য
রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''সরকারের কাছে সুযোগ আছে চাকরি দেয়ার। সরকার রিভিশন পিটিশন করেছে। সরকার যোগ্যদের তালিকাটা ফেলে দিন। তাহলে দুধ ও জল আলাদা হবে। কোনো বিতর্ক থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকার ও এসএসসির অসহযোগিতার জন্য যোগ্য ও অযোগ্য বাছতে পারলাম না। তিনি (মমতা) যদি বলেন, সবাইকে চাকরি দিলাম ১০ হাজার টাকা করে দেবো. সেটা মানবো না।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নবান্নর কাছে বিক্ষোভ
চাকরি না পাওয়া শিক্ষকদের একাংশ নবান্নর কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাদের দাবি, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন চাকরি পাবেন না তাদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সারা রাত চাকরিহারা শিক্ষকদের অপেক্ষা
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাবেন বলে কলকাতার বাইরে থেকে আসা শিক্ষকরা সারা রাত শহিদ মিনারের পাশে মাঠে ছিলেন। ‘যোগ্য’ লেখা কার্ড সংগ্রহ করে সকালে নেতাজি ইন্ডোরে যান তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ঢোকার সময় ঝামেলা
‘যোগ্য’ কার্ড না পাওয়ায় অনেক শিক্ষকই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয় তাদের।