হরতালে ককটেল আর যানবাহনে আগুনের ঘটনায় যাঁরা পুড়ছেন, তাঁদের দুর্বিষহ অবস্থা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই৷ যিনি পুড়েছেন, একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন এ যন্ত্রণা৷ আহতদের কেউ কেউ এই নরকযন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করছেন৷
বিজ্ঞাপন
গত তিন সপ্তাহে মোট ১০ দিন হরতাল পালন করল বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট৷ এই হরতালকে কেন্দ্র করে শুধু ঢাকাতেই ককটেল আর যানবাহনে আগুনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন৷ নারী, শিশু, এমনকি প্রতিবন্ধীরাও রেহাই পাননি আগুন থেকে৷ তাঁদের কারুর পুরো শরীর ঝলসে গেছে৷ আবার কারুর গেছে হাত-পা৷ কারুর চোখ নষ্ট হয়েছে৷ কারু বা ঝলসে গেছে পুরো শরীর৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিত্সক ডা. পার্থ শংকর পাল ডয়চে ভেলেকে জানান, এখন তাদের কাছে ২৪ জন চিকিত্সাধীন আছেন৷ হঠাত্ করে হরতালের কারণে পোড়া রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায়, তাঁরা তাঁদের চিকিত্সা দিতে হিমসিম খাচ্ছেন৷ তবে এটাই একমাত্র বিশেষায়িত চিকিত্সা কেন্দ্র হওয়ায়, তাঁরা রোগীদের অন্য কোনো হাসপাতালে পাঠাতেও পারছেন না৷ তাই মেঝেতে রেখে হলেও তাঁদের চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে৷
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
যাঁরা আগুনে বা ককটেলে আহত হয়েছেন, তাঁদের সবার করুণ কাহিনি প্রায় একই রকম৷ হরতালে বাস বা অন্য কোনো যানবাহনের যাত্রী হিসেবে আগুনের শিকার হয়েছেন তাঁরা৷ কোথাও বা বাসে সরাসরি আগুন দেয়া হয়েছে৷ কেউ আহত হয়েছেন যাত্রাবাড়িতে, কেউ সায়েদাবাদ, কেউ মহাখালি আবার কেউবা শিকার হয়েছেন মিরপুর এলকায়৷ আহতদের কাছ থেকে জানা যায়, বাসে আগুন বা ককটেল-বোমা ছোড়া হয় হঠাত্ করে৷ তবে যাত্রী হিসেবে বাসে উঠেও আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ এরা যাত্রীদের নামারও সময় দেয় না৷
বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতর তারেক আহমেদ জানান, তিনি বাসের মাঝের সিটে ছিলেন৷ অনেক যাত্রী দ্রুত নেমে গেলেও তিনিসহ কয়েকজন আর নামতে পারেননি৷ আগুন তাঁদের গ্রাস করেছে৷ পুরনো ঢাকায় সন্ধ্যার পর একটি লেগুনায় (হিউম্যান হলার) পেট্রোল-বোমা ছুড়ে মারা হলে, রবিবার রাতে ছয়জন যাত্রীই অগ্নিদগ্ধ হন৷ তাঁদের একজন আবুবকর সিদ্দিক জানান, তিনি ভাবতেও পারেননি যে তাঁর জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে আসবে৷ তাঁর জীবনের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে এভাবে৷
যাঁরা পুড়ে গেছেন, তাঁদের আত্মীয়স্বজনও এখন দিশেহারা৷ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খলিলের স্ত্রী শাহানা বেগমের কান্না যেন থামছে না৷ কারণ. গুরুতর আহত খলিল শেষ পর্যন্ত বাঁচবেন কিনা তা বলা যাচ্ছে না৷ আর বাঁচলেও কর্মক্ষম থাকার আশা খুবই কম৷ শাহানা বেগম জানান, হরতালের আগুনে শুধু তাঁর স্বামীই পোড়েননি, পুড়েছে তাঁদের গোটা সংসার৷
ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, যাঁরা এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাঁদের শরীরের ২৫ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে৷ তাঁদের অবস্থা সত্যিই আশঙ্কাজনক৷ তিনি জানান, তাঁদের বড় একটি অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন৷ কয়েকজনের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে৷ তাঁদের জন্য সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই৷
হরতালে এই নৃশংসতার জন্য বিরোধী দল দায়ী করছে সরকারকে৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, সরকারের লোকজন এই সব ঘটনা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাচ্ছে৷ অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন৷
এরপরও সামনের সপ্তাহে আবারও হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে৷ নেতারা হরতালে মাঠে না থাকলেও ককটেল আর আগুন যে থাকবে, তা বলা যায় প্রায় নিশ্চিত করেই৷ বলা বাহুল্য, বার্ন ইউনিটে আরো বাড়বে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা৷ পুড়বে মানুষ, পুড়বে সংসার, পুড়বে কপাল৷