পূজা অনুদানে মাথাচাড়া পুরোনো বিতর্কের
২ আগস্ট ২০২৫
বেড়েছে অনুদান
২০১৮ সাল থেকে রাজ্যে দুর্গাপূজার জন্য ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়ার রীতি শুরু হয়েছে৷ প্রতি বছর সেই অনুদান ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে যে অনুদান শুরু হয়েছিল, তা এখন ১ লাখ ১০ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে৷ গতবারের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে প্রায় ১০০ কোটি৷
অনুদান যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ক্লাবের সংখ্যা৷ ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এমন ক্লাবের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার৷ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রাজ্যে এখন ৪৫ হাজার ক্লাব বা কমিটি দুর্গাপূজা আয়োজন করে৷ ফলে ক্লাবের সংখ্যা যে ক্রমশ বাড়ছে, তা একেবারেই দৃশ্যমান৷
নেতাজি ইন্ডোরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ৮৫ হাজার থেকে এক লাফে ২৫ হাজার টাকা করে বেশি পাবে প্রতি পূজা কমিটি৷ একইসঙ্গে বিদ্যুতের বিলে গত বছর যে ছাড় ছিল, তা ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়েছে৷
রাজ্য সরকারের এই অনুদানের জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ হতে চলেছে৷ প্রতিবারের মতো এবারও রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে বিরোধীরা৷
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘‘আগে চাকরি দিন, ছয় লাখ শূন্যপদ পূরণ করুন, আশাকর্মী, চুক্তিভিত্তিক কর্মী, ভিলেজ পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ার, ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের বেতন বাড়ান৷ বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দিন৷ খুব অল্পদিনের মধ্যে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতাও বাড়তে পারে৷''
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘‘খেলা, মেলা এসব নিয়ে সরকার চলছে৷ তাই নির্বাচনের আগে পূজা কমিটিগুলোকে খুশি করতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী৷''
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘‘এটা পূজার অর্থনীতি৷ এই অর্থনীতি ৭৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে৷ পূজা অনুদান সমাজের মধ্যে রোল করে৷ অনেকে এই টাকায় উপকৃত হন৷ যারা বলছেন, এটা অপচয়, তারা জনগণের সামনে গিয়ে বলুন৷ তাদের উচিত শিক্ষা ভোটের সময় মানুষ দেবে৷''
ডিএ ও মিড ডে মিল সেই তিমিরেই
বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, কেন মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়বে না, কেন দেওয়া হবে না বকেয়া ডিএ৷
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের মহার্ঘভাতার ফারাক এখনও ৩৭ শতাংশ৷ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা ৫৫ শতাংশ হারে ডিএ পান৷ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ বকেয়া ডিএর জন্য টানা আন্দোলন করে চলেছে৷ মঞ্চের আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমাদের হকের পাওনা চাইতে গেলে রাজ্য সরকার বলছে টাকা নেই, অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে টাকা উথলে পড়ছে৷ জনগণের করের টাকায় স্থায়ী উন্নয়ন হওয়া উচিত৷ এই টাকায় পূজা করা উচিত নয়৷ আমি জানি না, কোনো পূজা কমিটি সরকারের অনুদানের অপেক্ষায় পূজার আয়োজন করে কিনা৷''
শুধু ডিএ নয়, মিড ডে মিলেও বহু দিন বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তোলা হচ্ছে৷ গত এপ্রিলে মিড ডে মিলে বরাদ্দ বেড়েছে সামান্য৷ প্রাথমিকের পড়ুয়ার জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ছয় টাকা ১৯ পয়সা থেকে ছয় টাকা ৭৮ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে নয় টাকা ২৯ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ১৭ পয়সা হয়েছে৷
রাজ্য সরকারের পূজা অনুদানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করছেন সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য৷ তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তে যারা উল্লসিত, তারা বুঝতে পারছেন না, এটা তাদের ঘাড় ভেঙে আদায় করা হবে৷ সরকার শিল্পীদের ডেকে অনুদান দিক, ক্লাবকে কেন দেবে৷ পশ্চিমবঙ্গে কি আগে বড় মাপের পূজা হতো না, সেখান থেকে শিল্পীরা উপকৃত হতেন না? এতে তো সরকারের অংশগ্রহণ ছিল না৷''
ধর্মের রাজনীতি
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রায় প্রতিটি সভা ও মিছিলে রাজ্যের সংখ্যাগুরু জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন৷ উল্টোদিকে তৃণমূল একের পর এক নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের সমর্থন পাচ্ছে, এটা ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার পূজা অনুদানের ঘোষণা করেছে৷
পহেলগামে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অপারেশন সিঁদুরকে সামনে রেখে আগ্রাসী প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি৷ সেই সময়ে পূর্ব মেদিনীপুরের পর্যটনস্থল দিঘায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করে জগন্নাথধামের নির্মাণ হয়েছে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়৷ এই সরকারই সারা রাজ্যের পূজা কমিটির জন্য বছরের পর বছর অনুদান বাড়িয়ে চলেছে৷
পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এসব উদ্যোগের পিছনে ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য আছে৷ সিনিয়র সাংবাদিক প্রসূন আচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মমতা ধর্মীয় রাজনীতি যদি নাই করতেন, তাহলে দিঘায় জগন্নাথের মন্দির করতে গেলেন কেন? তিনি পূজার অনুদানের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন৷ ২০২০ সালে টাকার অংকটা বাড়িয়েছিলেন ২১-এর নির্বাচনের আগে৷ আবার ২৬-এর নির্বাচনের আগে এ বছর অনুদানে একটা কোয়ান্টাম জাম্প হলো৷ সামগ্রিকভাবে ভোট, হিন্দুদের খুশি করা, অর্থনীতিতে কিছু টাকা পাম্প করা, এই সব মিলিয়ে উনি পূজার অনুদান দিয়ে থাকেন৷''
ভোটের রাজনীতি
বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচনি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যেই ক্লাব ও পূজা কমিটিকে অনুদান দিচ্ছে রাজ্য সরকার৷ কিন্তু দুর্গোৎসবের জাঁকজমক যেখানে বেশি অর্থাৎ শহর এলাকায় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে অন্য ছবি দেখা গেছে৷ কলকাতা ও জেলা শহরের পুর এলাকায় বিজেপি পিছনে ফেলেছে তৃণমূলকে৷
প্রসূন বলেন, ‘‘ক্লাবকে হাতে রাখা মানেই পুরসভাগুলোতে জেতা নয়৷ গত লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াই হয়েছিল, পুরসভাগুলোতে তার প্রভাব পড়েছিল৷ এবার আরজি কর থেকে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল, এই বিভিন্ন ইস্যুতে শহরাঞ্চলে তৃণমূল ভোট কিছু কমবে৷ অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যুতে গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের ভোট বাড়বে৷ হয়তো তৃণমূল নেত্রীর মাথায় এটা ছিল যে, আর্থিক অনুদান বাড়িয়ে, বিদ্যুতের বিলে ছাড় দিয়ে শহরের কিছু ভোট পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে৷''
অনুদান বয়কট
ইতিমধ্যে পূজার অনুদান বয়কটের সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছে একাধিক পূজো উদ্যোক্তা৷ নারী সুরক্ষা ও ডিএ ইস্যুতে রাজ্য সরকারের পূজা অনুদান নেবেন না উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ বিদ্রোহী ক্লাবের সদ্যসেরা৷ নদিয়ার রানাঘাটের চারের পল্লী ও কল্যাণীর 'ইচ্ছে তাই' নামের মহিলা দুর্গা পূজা কমিটি আরজিকর ইস্যুতে গতবারের মতো এবারও অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছে৷ গত বছর মাত্র ৫৯টি পূজা কমিটি অনুদান নেয়নি৷ প্রায় ৪৫ হাজার পূজা কমিটির মধ্যে এই সংখ্যাটা অত্যন্ত নগণ্য৷