পৃথিবীতে পানি পর্যাপ্ত বলেই আমরা জানি৷ কিন্তু ব্যাপক কৃষিকাজ, মাত্রাধিক পানি খরচ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের সবুজ গ্রহটিতে পানির আকাল দেখা দিতে পারে, বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা৷
বিজ্ঞাপন
ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগের দু'ভাগই সাগরের পানিতে ঢাকা, তা সে কম করেও এক বিলিয়ন ট্রিলিয়ন লিটার পানি৷ এমন গ্রহতে পানির আকাল হয় কী করে?
পৃথিবীর পানির অধিকাংশ কিন্তু মিঠা পানি নয়, নোনা জল৷ বলতে কি, সমগ্র পানির মাত্র আড়াই শতাংশ মিঠা পানি; সেই মিঠা পানির দুই-তৃতীয়াংশ আবার বরফ হয়ে জমে আছে সুমেরু, কুমেরু আর বিশ্বের নানা হিমবাহে৷ যেটুকু তরল মিঠা পানি বাকি থাকে, তাই দিয়ে মানুষের পান থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, ক্ষেতে সেচ দেওয়া থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশুদের তৃষ্ণা মেটানো, সমস্ত কাজ চালাতে হয়৷
সুবিধার দিকে এটাও বলতে হয় যে, পানি একটি নবায়নযোগ্য সম্পদ যা চক্রাকারে পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের পৃথিবী গ্রহে মোট পানির পরিমাণ চিরকাল মোটামুটি একই থাকবে – অর্থাৎ ফুরিয়ে যাবে না৷ এখন প্রশ্ন হল, সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি থাকবে কিনা৷
জলাভাব
নেদারল্যান্ডসের টোয়েন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভবিষ্যতে মোট ৪০০ কোটি মানুষ বছরে অন্তত একটি মাসের জন্য তীব্র জলাভাবের সম্মুখীন হতে পারেন৷ বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে ইতিমধ্যেই খরা ও ব্যাপক জলাভাব দেখা দিয়েছে, যেমন হর্ন অফ আফ্রিকা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ বছরের পর বছর খরার শিকার হয়ে ক্ষুধা ও ব্যাধিতে পীড়িত হচ্ছেন৷ ওদিকে পাকিস্তান ২০২৫ সালের মধ্যেই পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে, বলে জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে৷
একটু পানির জন্য
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে প্রত্যন্ত ১৩টি গ্রামের মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে অভিনব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ জার্মানির এক ফাউন্ডেশন এতে সহায়তা করছে৷
ছবি: M. Gundlach
প্রত্যন্ত এলাকা
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে অবস্থিত ১৩টি গ্রামে প্রায় ৪০০ মানুষের বাস৷ গ্রামগুলো এতই প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত যে, সেখানকার বাসিন্দাদের পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয়৷ প্রতিদিন এই কাজে গড়ে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়৷ সাধারণত নারীরাই এই কাজটি করে থাকেন৷ তবে একটি প্রকল্প তাঁদের কষ্ট লাঘবের স্বপ্ন দেখাচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
সমাধান কুয়াশা
এলাকাটি বছরের প্রায় ছ’মাস ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে৷ সেই কুয়াশাকে কাজে লাগিয়েই গ্রামবাসীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
কুয়াশা ধরতে জাল
পাহাড়ের উঁচুতে স্থাপিত বিশেষ জালে কুয়াশা আটকে পানি হয়ে ঝরবে৷ পানি ধরার জন্য থাকবে বড় বড় পাত্র৷ এরপর পাইপের মাধ্যমে তা পাহাড়ের নীচে অবস্থিত গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হবে৷ ঘন কুয়াশার সময় এক বর্গমিটার জাল থেকে দিনে প্রায় ২২ লিটার পানি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা৷ ভিডিও দেখতে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: M. Gundlach
জার্মান সহায়তা
যে প্রযুক্তিতে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে তার নাম ‘ক্লাউডফিশার’৷ জার্মানির ভাসাস্টিফটুং ফাউন্ডেশনের প্রকৌশলী পেটার ট্রাউটভাইন এটি উদ্ভাবন করেছেন৷ মরক্কোর বেসরকারি সংস্থা ‘দার সি হামদ’ ঐ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইতিমধ্যে প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কাজ শেষ করেছে৷ ফলে কিছু গ্রামের বাসিন্দারা এখনই তাদের ঘরে পানি পাচ্ছেন৷ কয়েকদিনের মধ্যে সবার জন্য পানির ব্যবস্থা করতে আরও জাল স্থাপনের কাজ শুরু হবে৷
ছবি: M. Gundlach
শিক্ষিত হচ্ছেন নারী
যে গ্রামগুলোতে ইতিমধ্যে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার নারীদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় বেঁচে যাওয়ায় এখন তাঁরা লেখাপড়া শেখা থেকে শুরু করে অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারছেন৷ প্রকল্পের আওতায় তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে৷
ছবি: Ane Nordentoft/Transterra Media
কাজের স্বীকৃতি
প্রকল্পটিকে সম্প্রতি জাতিসংঘের ক্লাইমেট চেঞ্জ পুরস্কার দেয়া হয়েছে৷ কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প বলে ধারণা করা হয়৷ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসির মুখপাত্র নিক নাটাল বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এ ধরনের অভিনব পরিকল্পনা সত্যিই এক দারুণ ব্যাপার৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি আরো করুন হবে৷ জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বের আবহাওয়া ওমেঘ-বৃষ্টির নকশা বদলে দিচ্ছে, যার ফলে কোনো কোনো এলাকায় খরা ও অপরাপর এলাকায় অতিবৃষ্টি ও বন্যার অবতারণা ঘটছে৷ উচ্চ তাপমাত্রার ফলেও জলাশয়ের পানি উপে গিয়ে জলাভাব সৃষ্টি হতে পারে৷ আবার পানি সম্পদের ভুল ব্যবস্থাপনাও জলাভাবের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ মাত্রাধিক নিষ্কাশনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে; অপরদিকে নদী ও হ্রদ ইত্যাদি হয় শুকিয়ে আসছে, নয়ত দূষণের ফলে তাদের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠছে৷
কৃষি
যে সব ক্ষেত্রে পানির ব্যবহার সর্বাধিক, তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে কৃষিকাজ৷ বিশ্বের যাবতীয় মিঠা পানির প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয় সেচে ও গৃহপালিত পশুদের পানি দিতে৷ আধুনিক কৃষিতে একদিকে যেমন পানির ব্যবহার কমানো সম্ভব হয়েছে, অপরদিকে কৃষিকাজের তীব্রতা ও ফলন বাড়ার দরুণ কোনো কোনো এলাকায় পানির চাহিদা স্থানীয় পানির সরবরাহকে ছাড়িয়ে গেছে – যেমন গোটা ইউরোপের টমেটো উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ আসে স্পেনের টমেটো চাষের এলাকাগুলিতে; কাজেই এখানে জলাভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক৷
পানির চাহিদা বাড়ছে
পানি ব্যবস্থাপনা যতই আধুনিক ও সুকৌশলী হোক না কেন, পানির চাহিদা যেভাবে বেড়ে চলেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা সেই ব্যবস্থাপনার নেই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রান্নাবাটি ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রতিটি মানুষের দিনে ২০ লিটার বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন – স্নান অথবা কাপড় কাচাকে এর মধ্যে ধরা হয়নি৷ শিল্পোন্নত দেশগুলিতে পানির ব্যবহার এর চাইতে অনেক বেশি: জার্মানিতে একজন নাগরিক দিনে গড়ে ১৪০ লিটার পানি খরচ করে থাকেন, তার মধ্যে ৩০ লিটার যায় টয়লেট ফ্লাশ করতে৷
আমাদের ‘ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট' কার্বন ফুটপ্রিন্টকেও হারিয়ে দিতে পারে: এক কেতলি কফি তৈরি করতে সব মিলিয়ে পানি খরচ হয় ৮৪০ লিটার, একজোড়া জিন্স তৈরি করতে লাগে ৮,০০০ লিটার পানি৷
কাটারিনা ভেকার/এসি
বন্ধু, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আপনি কি কিছু করছেন? লিখুন নীচের ঘরে৷
জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে যা যা করতে পারেন
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, বিশেষ করে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা কমানোর উপায় নিয়ে বছর জুড়েই চলে আলোচনা৷ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগেরও শেষ নেই৷ ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট ছোট কিছু উদ্যোগও কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Bildagentur-online
লাইটের বাল্ব বদলে ফেলুন
ঘরে খুব সুন্দর সুন্দর লাইট লাগিয়েছেন? সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি এসব লাইটের বাল্ব অনেক সময় খরচও বাড়ায়৷ বিদ্যুতের খরচ কমাতে চাইলে শিগগির এলইডি বাল্ব লাগিয়ে নিন৷ অন্য সব বাল্বের চেয়ে এলইডি বাল্ব শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত কম বিদ্যুৎ খরচ করে৷
ছবি: DW/Gero Rueter
সব কাপড় রোদে-হাওয়ায় শুকান
কাপড় শুকানোর জন্য ড্রায়ার ব্যবহার করেন? যখনই সম্ভব ধোঁয়া কাপড় ড্রায়ারে না দিয়ে বাইরে টানিয়ে দিন৷ একটু সময় লাগলেও এক সময় কাপড়গুলো ঠিকই শুকিয়ে যাবে৷ বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি যত কম ব্যবহার করবেন, ততই উপকার৷ জানেন তো, বিশ্বের উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর? ড্রায়ার আপনার কাপড় শুকায় ঠিকই, পাশাপাশি উষ্ণতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে৷
ছবি: picture-alliance/AP/Hussein Malla
রিসাইক্লিং
বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখতে অনেক জিনিসই রিসাইক্লিং, অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার করার চল শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে৷ তবে রিসাইক্লিংয়ের চর্চা থেকে অনেক মানুষই এখনো দূরে৷ একজন একজন করে শুরু করলেও সংখ্যাটা বাড়বে৷ জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধের জন্য সেটাও কাম্য৷
ছবি: Fotolia/TrudiDesign
ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধোয়া ভালো
আপনি কি গরম পানিতে কাপড় ধুয়ে অভ্যস্ত? তাহলে কিন্তু গ্রিন হা্উ গ্যাস নির্গমন বাড়িয়ে আপনি জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছেন৷ ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধোয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়৷ সহজ এই কাজটি করেও পরিবেশের উপকার করতে পারেন৷
ছবি: Fotolia/Kzenon
হাইব্রিড গাড়ি চালান
গাড়ির ধোঁয়া পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে৷ তাই গাড়ি যদি চালাতেই হয়, তাহলে হাইব্রিড ইলেকট্রিক গাড়ি কিনুন৷ তাতে ক্ষতি কিছুটা কম৷
ছবি: picture-alliance/Photoagency Interpress
গরু, খাশির মাংস কম খান
গরু, খাশি এবং অন্যান্য পশুর মাংস খাওয়া কমিয়ে বা পুরোপুরি বাদ দিয়ে নিরামিষভোজী হলেও পরিবেশের উপকার৷
ছবি: FOX BROADCASTING/The Simpsons
স্বল্প দূরত্বে বিমানযাত্রা কমান
বিমান চলাচলেও পরিবেশের অনেক ক্ষতি৷ ফলে আপনি যদি দেশের ভেতরে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার সময় অন্তত বিমানে না ওঠেন, তা পরিবেশ রক্ষায় কিছুটা ভূমিকা অবশ্যই রাখবে৷
ছবি: picture-alliance/P. Mayall
গাড়ি ছেড়ে বাইসাইকেল
যে কোনো ধরনের গাড়ি বর্জন করে যদি বাইসাইকেলে যাতায়াত করেন তাতে শরীর এবং পরিবেশ দুয়েরই উপকার৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
বেশি সন্তান নয়
জনসংখ্যা বাড়লে পরিবেশের ওপর চাপও বাড়ে৷ ফলে বেশি সন্তান না নেয়াই ভালো৷