চাঁদের রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে আসলে পৃথিবীর বিবর্তন সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া গেছে৷ অ্যাপোলো অভিযানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সামগ্রিকভাবে সৌরজগতের অনেক অজানা খবরও জানা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
চাঁদের ছয়টি জায়গায় অবতরণ করে অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরা মাটি তুলে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন৷ কয়েকটি জায়গায় ড্রিলিং করে মাটির বেশ কয়েক মিটার গভীর অংশ থেকে নমুনা তোলা হয়েছিল৷ এভাবে সূক্ষ্ম ধুলিকণা থেকে ফুটবলের সাইজের খণ্ড পাওয়া গেছে৷
চাঁদের মাটির নমুনা সত্যি মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল৷ রাল্ফ ইয়াউমান-এর মতো জ্যোতির্বিদ এর মাধ্যমে অনেক নতুন জ্ঞান অর্জন করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এই পাথর অবশ্যই অন্য এক মহাজাগতিক বস্তু থেকে এসেছে৷ পাথর হিসেবে এটি অতি প্রাচীন৷ সে কারণে এটি অত্যন্ত মূল্যবান৷ গত ৪০০ কোটি বছর ধরে কীভাবে চাঁদের বিকাশ ঘটেছে, এই পাথর থেকে তা জানা যায়৷ পৃথিবীর খুব কাছে থাকার কারণে এই পাথর সেখানকার বিকাশ সম্পর্কেও কিছু ইঙ্গিত দিতে পারে৷''
এমন তথ্য খোদ পৃথিবীর বুকে পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই৷ কারণ সেখানে শিলার রূপান্তর ঘটে চলেছে৷ মাটির নীচে ভূ-স্তরের প্লেটগুলির স্থানান্তর ঘটে৷ ফলে পাথর গলে গিয়ে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে আবার বেরিয়ে আসে৷ সে কারণে পৃথিবীর আদি অবস্থার চিহ্ন লোপ পেয়েছে৷
অন্যদিকে চাঁদ অনেকটা সংরক্ষিত এলাকার মতো৷ সেখানকার আদি রূপ ও বিবর্তনের ইতিহাস আজও অক্ষত রয়েছে৷ মানুষ চাঁদের বুকে নামার আগে একাধিক স্যাটেলাইট তার উপরিভাগ পর্যবেক্ষণ করেছিল৷ সেই সব ছবির সাহায্যে চাঁদের গহ্বরের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছিল৷ বহুকাল ধরে গবেষকদের ধারণা ছিল, যে সেই সব গহ্বর আসলে আগ্নেয়গিরি৷
তারপর জানা গেল, বিপুল গতিতে গ্রহাণু আছড়ে পড়ায় সেই সব গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে৷ যেমন একটি গহ্বরের ব্যাস ৯০ কিলোমিটার৷ আল্পসের মতো উঁচু পর্বতশ্রেণি তার চারিপাশ ঘিরে রয়েছে৷ গ্রহ ভূবিজ্ঞানী হিসেবে রাল্ফ ইয়াউমান বলেন, ‘‘কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ পৃথিবীতে তেমনটা ঘটে নি৷ প্লেটগুলির সংঘর্ষের ফলে কোটি কোটি বছর ধরে পর্বত জেগে উঠেছে৷ তারপর উধাও হয়ে গেছে৷ চাঁদের বুকে কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন পরিবর্তন ঘটেছে৷ তারপর এমন বিশাল পর্বতশ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে৷ ফলে পৃথিবীতে ভূতত্ত্বের বিবর্তন সম্পর্কে ধারণারও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে৷''
গবেষণাগারে চাঁদের পাথরের বয়স নিখুঁতভাবে জানা গেছে৷ ফলে গ্রহগুলির বিবর্তন সম্পর্কে অনেক নতুন জ্ঞান পাওয়া গেছে৷ রাল্ফ ইয়াউমান বলেন, ‘‘এখন যদি কেউ বলে, যে শুধু চাঁদ নয়, গোটা সৌরজগতের ক্ষেত্রেই সেটা খাটে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য গ্রহগুলির ক্ষেত্রেও এই উপলব্ধি প্রয়োগ করা যায়৷ অর্থাৎ চাঁদই আমাদের সৌরজগতের বিবর্তনের সময়সূচি দিয়েছে৷ অ্যাপোলো মিশনের আগে সেটা ছিল না৷''
সেই বিবর্তন ছিল আলোড়নে ভরা৷ মহাজাগতিক বস্তুগুলির উপর বার বার গ্রহাণু ও ধূমকেতু আছড়ে পড়েছে৷ প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে সেই বোমাবর্ষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷
চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণের মাত্র ছয় বছর পর গবেষকরা নতুন এক তত্ত্ব সৃষ্টি করেন৷ তাঁদের মতে, প্রায় মঙ্গলগ্রহের মতো বড় কোনো মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে যে সব টুকরো ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেগুলি দিয়েই চাঁদ সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি৷
অ্যাপোলো ১১: চন্দ্র জয়ের সাক্ষী
পেরিয়ে গেল ৫০ বছর৷ প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং৷ যা মানব সভ্যতার অগ্রাযাত্রায় যোগ করেছিল ভিন্নমাত্রা৷ সেদিনের স্মৃতিচিহ্ন আজো বিস্ময় জাগায়৷
ছবি: NASA
জুলাই ২০, ১৯৬৯: দৃপ্ত পদক্ষেপ
চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পায়ের ছাপ৷ চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখার অভিজ্ঞতায় নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন সেই বিখ্যাত কথাটি, ‘‘মানুষের জন্য এটি একটি ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় এটি অনন্য সোপান৷’’ কিভাবে এবং কখন তিনি এই বাক্যটি বলেছেন আর কণ্ঠস্বর কিভাবে ভুলে গেছেন, তার আলোচনা আজও চলছে৷
ছবি: NASA
জুলাই ১৬, ১৯৬৯: চাঁদের দিকে যাত্রা
এবার আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক৷ যাত্রা শুরুর আগে, কেনেডি স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে একরাশ উত্তেজনা৷ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে শেষ মূহূর্তের সবকিছু দেখভাল করছিলেন অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পরিচালক স্যামুলেয় সি ফিলিপস৷ তারপর চন্দ্র জয়ের আকুলতায় ছুটতে থাকে অ্যাপোলো ১১৷ সঙ্গে ছিলো তিন যাত্রী: নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন আলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স৷
ছবি: NASA
জুলাই ১৬, ১৯৬৯: স্পেস টিভি
অ্যাপোলোর উড়ান দিনের কথা৷ অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছে নাসা স্পেসপোর্টের কেনেডির স্পেস সেন্টারের আশেপাশে৷ তাদের কেউ সমুদ্র পাড়ে আবার কেউ রাস্তায় তাঁবু খাটিয়ে কোনোরকম সময় পার করছে৷ লক্ষ্য অ্যাপোলোকে বিদায় দেয়া, আর ইতিহাসের স্বাক্ষী হওয়া৷ উড়ান দেখতে সেদিন জড়ো হয়েছিলেন প্রায় লাখ দশেক মানুষ৷
ছবি: NASA/Kennedy Space Center
জুলাই ১৬, ১৯৬৯: লাইটস, ক্যামেরা, অ্যাকশন
সেদিন শুধু লাখো মানুষ জড়ো হয়েছে, তা কিন্তু নয়৷ হাজারো সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন অ্যাপোলো মিশনের সংবাদ সংগ্রহে৷ সেদিন তিন হাজার ৪৯৭ জন সাংবাদিক কেনেডি স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের প্রেস এরিয়াতে সমবেত৷ এটা হলো অফিসিয়ালি নিবন্ধিত সাংবাদিকদের সংখ্যা৷ ধারণা করা হয়, সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি৷
ছবি: NASA
জুলাই ২১, ১৯৬৯: খুব কাছে
চাঁদ প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসছে লুনার মডিউল ঈগল৷ ছবিটি তুলেছিলেন মাইকেল কলিন্স৷ ঈগল যখন আসছিল তখন তার পেছনে চাঁদ৷ আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পৃথিবী৷ আর্মস্ট্রং এবং আলড্রিন যখন চাঁদে পা রাখছিলেন, তখন নির্দেশনা অনুযায়ী কলম্বিয়া কমান্ড মডুলে অবস্থান করছিলেন কলিন্স৷ সাড়ে একুশ ঘণ্টা সে চাঁদকে একা প্রদক্ষিণ করেন৷
ছবি: NASA
জুলাই ২০, ১৯৬৯: টিমওয়ার্ক
২০০৯ সালে নাসার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়৷ সেখানে কলিন্স বলেন, ‘‘চন্দ্র পৃষ্ঠে যা ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমি বেশ উৎসাহী ছিলাম৷ আমি জানি, যদি আমি দাবি করি অ্যাপোলোরর তিনজনের মধ্যে আমি সেরা ছিলাম, তাহে এটা খুব বোকামি হবে না হয় আমি মিথ্যেবাদী৷ কিন্তু চন্দ্রাভিযানের একজন হতে পেরে আমি খু্বই সন্তুষ্ট৷’’
ছবি: NASA/Kennedy Space Center
জুলাই ২০, ১৯৬৯: ‘ঈগল অবতরণ করেছে!’ কিন্তু...
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই, সময়ের ঘড়িতে তখন রাত ৮টা ১৭ বেজে ৫৮ সেকেন্ড৷ নীল আর্মস্ট্রং ক্ষুদ্র বার্তায় জানালেন, ‘‘ঈগল অবতরণ করেছে!’’ কিন্তু তারা দুজন চাঁদের মাটিতে পা রাখতে আরো সময় নিয়েছিলেন৷ অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ৷ ২১ জুলাই, রাত ২টা ৫৬ মিনিট ২ সেকেন্ডে প্রথম মানব হিসেবে চাঁদের বুকে পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং৷
আড়াই ঘণ্টার চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটাহাঁটি করেন আর্মস্ট্রং আর আলড্রিন৷ এই সময়ের মধ্যে তাঁরা ৪৭ পাউন্ডের সমপরিমাণ নানা বস্তু যোগাড় করেন৷ যা ফেরার সময় পৃথিবীতে নিয়ে আসেন৷ ১০০০৩ নম্বর নমুনাটিও সেই সংগ্রহের ছোট্ট একটি উপাদান৷ অ্যাপোলো থেকে দুই হাজার ৪১৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়৷ যার ওজন প্রায় চারশো কেজি৷ ‘লুনার স্যাম্পল আর ফটো ক্যাটালগে’ চন্দ্র উপাদানের সংগ্রহ আর বর্ণনা আছে৷
ছবি: NASA/AccuSoft Inc.
জলপাই গাছের ডাল
চাঁদ থেকে নিয়ে আসা নমুনা সংগ্রহ করে ক্ষান্ত হয়নি কর্তৃপক্ষ৷ নভোচারীদের ব্যবহার্য সব উপকরণও সংগ্রহে রেখেছে তারা৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ব্রোচ৷ নীল আর্মস্ট্রংয়ের এই ব্রোচটি যেন চন্দ্রবিজয়ের প্রতীক হয়ে আছে৷ জলপাই গাছের ডাল যেন বলছে শান্তির কথা৷
ছবি: NASA/Johnson Space Center
জুলাই ২৪, ১৯৬৯: পৃথিবীর বুকে ফেরা
নভোচারীরা অবতরণ করলেন প্রশান্ত মহাসাগরে৷ হাওয়াই থেকে ৮১২ নটিক্যাল মাইল আর ইউএসএস হর্নেট থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল তাঁদের অবতরণের জায়গাটি৷ ফেরার পর, তাঁদের কিন্তু কাস্টমসের ফরম পূরণ করতে হয়েছে৷ এমনকি তাদের ঘোষণা দিতে হয়েছে যে, তাঁদের কাছে চাঁদের পাথর আছে৷ শরীরের রোগ বালাইয়ের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘টু বি ডিটারমাইন্ড৷’ তারপর তাদের কোয়ারান্টাইন ট্রেলারে করে ২১দিন বিচ্ছিন্ন রাখা হয়৷
ছবি: NASA/Johnson Space Center
সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৬৯: নভোচারীর সাজে মহাতারকারা
৪৫ দিনের বিশ্বসফরে বের হন মহাকাশচারীরা৷ এই সময়ে ২৪টি দেশ আর ২৭টি নগর যান তাঁরা৷ যুক্তরাষ্ট্র সরকারও চেয়েছে তাদের নভোমণ্ডলীয় অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে৷ যেখানে মহাকাশচারীরা গিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন উষ্ণ অভ্যর্থনা৷ মেক্সিকো সিটিতেও পেয়েছেন সংবর্ধনা৷