ক্রিকেটার বনাম বিসিবি৷ লড়াইটা হয়ে উঠেছে এমনই৷ তাতে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার স্পষ্ট পক্ষপাত ক্রিকেটারদের দিকে৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পেশাদারিত্বকেই বরং কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি সাকিব আল হাসানের এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বেশ আলোচনা হচ্ছে৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও এর এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে৷ পুরো ব্যাপারটি আপনি কিভাবে দেখছেন?
শফিকুলহকহীরা : আমি মনে করি, এটি দুর্ভাগ্যজনক৷ আমাদের ক্রিকেট বোর্ড পৃথিবীর সবচেয়ে অপেশাদার ক্রিকেট বোর্ড, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ সাকিব তো ই-মেইল করেছে৷ সে আইপিএল খেলতে চেয়েছে৷ এ বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যেহেতু ভারতে হবে, সেখানে আইপিএলে বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেললে ওর উপকার হবে৷ বোর্ড ওকে ছুটি দিয়েছে৷ সাকিব যে ই-মেইল দিয়েছে, সেটি কেউ পড়েনি৷ এটি পড়ার সামর্থ্য আকরামের আছে কিনা, আমি তা-ও তো জানি না৷ আমি জানি না, ও কতটা শিক্ষিত৷ সাকিব যেটা বলেছে, সেটি আমি পাঁচ বছর ধরে বলে আসছি৷ আমাদের ক্রিকেট বোর্ড পেশাদার না৷ এখানে প্রতিটি বিভাগের চেয়ারম্যানের (সপ্তাহে) তিন-চারদিন তিন-চার ঘন্টা করে অফিস করা দরকার৷ প্রোগ্রামগুলো কী অবস্থায় আছে, সেগুলো দেখভাল করবে৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোনো বোর্ড সদস্য আসে না৷ এলেও আড্ডাবাজি করে৷ বোর্ড প্রেসিডেন্ট যদি ক্রিকেট পছন্দ করেন, সেই পছন্দ করা দিয়ে তো কোনো লাভ হবে না৷ উনি কি দেখছেন না, বোর্ড সদস্যদের কাছ থেকে কী পাচ্ছেন? বেশিরভাগ বোর্ড সদস্যের ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে ধারণা কম৷ তারা বেশিরভাগই ব্যবসায়ী৷ আর বোর্ডের মিটিংও কম হয়৷
বোর্ডের পরিচালক হিসেবে তো এখন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কই আছেন তিন জন৷ সাবেক ক্রিকেটারও আছেন আরো কয়েকজন...
সাবেক অধিনায়ক মানে কিন্তু এটা নয় যে, সে টেকনিক্যাল দিক ভালো জানবে৷
বোর্ড পরিচালকদের বিপক্ষে সাকিবের যে অভিযোগ, সেটি কিন্তু মূলত আকরাম খানের ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগ এবং নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের হাই পারফর্ম্যান্স ইউনিট৷ মানে জাতীয় দলের সাবেক দুই অধিনায়কের অধীনে থাকা কমিটি নিয়ে৷
ঠিক তাই৷ আগে ওরা চুক্তিভুক্ত ছিল৷ সে কারণে বলার সুযোগ পায়নি৷ এখন যেহেতু ওরা বোর্ডের চুক্তির বাইরে, সে কারণে বলতে পারছে৷
সাকিব ফেরার পর তো কেন্দ্রীয় চুক্তি হয়নি৷ কিন্তু যখন চুক্তি হবে, সেটি তো ব্যাকডেটে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে৷
ঠিক আছে, সেটি বোঝা গেল৷ সাকিব চালাক ছেলে৷ বিভিন্ন বড় বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছে, ও ক্রিকেট বিষয়ে অনেক কিছু জানে৷ আমি নিশ্চিত যে, ও যেদিন সই করবে, সেদিন থেকে চুক্তিভুক্ত বলে নিজেকে ধরবে৷ যদি ২৯ মার্চ চুক্তি হয়, ও সেদিন থেকে কথা বলা বন্ধ করে দেবে৷
শুধু সাকিব তো নন, মাশরাফিকেও আমরা দেখি মাঝেমধ্যে বোর্ডের বিপক্ষে কথা বলেন৷ তাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেন৷ এবং তারা যেসব বলেন, এর বেশিরভাগই যৌক্তিক বলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন৷ এই যে বোর্ড ও ক্রিকেটারদের অবস্থান, তা আমাদের ক্রিকেটের জন্য কতটা দুর্ভাগ্যজনক?
‘ক্রিকেটারদের কারণে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চেনে’
খুবই দুর্ভাগ্যজনক৷ এর কারণ হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেট বোর্ড পেশাদার না৷ এসব আমি পাঁচ-ছয় বছর ধরে বলে আসছি৷ কিন্তু কেউ শোনে না৷ এখন ওরা বলছে৷ ওদের পুরো দেশ চেনে, ওদের কারণে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চেনে৷ এখন ওরা যদি কোনো কথা বলে, সেটির গুরুত্ব অনেক বেশি৷ কারণ, সাকিব এটা বলেছে৷ ও অহেতুক কিছু বলবে না৷ সাকিব মনের কথা বলেছে৷ সেখানে একটু ভুল হতে পারে, একটু বাড়তি বলতে পারে, কিন্তু ও মনের কথা বলেছে৷
এখন সাকিব-মাশরাফিরা যখন বোর্ডকে নিয়ে নানা কথা বলছেন, তাতে চিত্রটা কি একটু হলেও পাল্টাবে বলে মনে করেন?
সাকিব নিজের অ্যাকাডেমি করে দেখিয়ে দিয়েছে ও ক্রিকেট ভালোবাসে৷ ও চায়, ক্রিকেটটা যেন পেশাদারভাবে পরিচালিত হয়৷ যেভাবে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড চলে; অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড চলে৷ আমাদের বোর্ড কেন সেভাবে চলতে পারে না? এখন ওরা বলার পর অবস্থান পরিবর্তন অবশ্যই হবে৷ প্রত্যেক ক্রিকেটার সাকিব হবে না৷ ও আউটস্ট্যান্ডিং৷ তবে ও চায়, অন্য ক্রিকেটাররা যেন ওর কাছাকাছি পর্যায়ে উঠে আসে৷ তাহলেই কেবল আমাদের একটি ভালো দল হবে৷ আমি অবশ্যই আশা করছি, এখন সাকিব কথা বলার পর তা কার্যকর হবে৷ মাশরাফীর কথা কার্যকর হবে৷ এখন নিশ্চয়ই বোর্ড দেখবে, তারা কোথায় ভুল করেছে৷ সেগুলো শোধরানোর সুযোগ এখন আছে৷
ক্রিকেট ইতিহাসে বোর্ড ও ক্রিকেটারের বিবাদ
ক্রিকেটের বোর্ড বা ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্বে জড়ানোর অনেক উদাহরণ আছে৷ এমনকি ডন ব্র্যাডম্যানও বাদ যান না সেই তালিকা থেকে৷ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো ছবিঘরে৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
ব্র্যাডম্যানের হুমকি
ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরাকেও বোর্ডের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে হয়েছিল৷ সময়টা ১৯৩১ সাল৷ লেখালেখির জন্য অ্যাসোসিয়েট নিউজপেপারের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি করেন ডন ব্র্যাডম্যান৷ অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড অব কন্ট্রোল তাতে বাধ সাধে৷ ব্র্যাডম্যানও সাফ জানিয়ে দেন প্রয়োজনে ক্রিকেট ছাড়বেন তবু চুক্তির অসম্মান করবেন না৷ বিষয়টির সুরাহা হয়েছিল অ্যাসোসিয়েট নিউজপেপারের সম্পাদকীয় প্রধানের মধ্যস্থতায় চুক্তি বাতিলের মাধ্যমে৷
ছবি: Getty Images/Allsport Hulton
অসিদের টালমাটাল দশক
১৯৭০-এর দশকে খেলোয়াড়াদের সঙ্গে বোর্ডের টানাপোড়েনে অচলাবস্থা তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে৷ বেতন বাড়ানোর দাবিতে ১৯৭৫ সালে এক পর্যায়ে ক্রিকেটাররা ধর্মঘটেরও হুমকি দেন৷ জবাবে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তখনকার ক্রিকেট বোর্ডের সেক্রেটারি অ্যালান বার্নার বলেছিলেন, পাঁচ লাখ ক্রিকেটার আছেন, যারা বিনা পয়সায় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে চাইবেন৷ ছবিতে, ১৯৬৩ সালের অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা৷
ছবি: Albert McCabe/Daily Express/Hulton Archive/Getty Images
ক্যারি প্যাকারের ‘বিদ্রোহী লিগ’
অস্ট্রেলিয়ার ‘মিডিয়া টাইকুন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ক্যারি প্যাকার৷ ১৯৭৬ সালে নিজের মালিকানার চ্যানেল নাইনকে টেস্ট ম্যাচ সম্প্রচারের স্বত্ত্ব না দেয়ায় বোর্ডের উপর ক্ষুব্ধ হন৷ প্রতিশোধ হিসেবে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট নামে আলাদা লিগ চালু করেন৷ ব্যক্তি মালিকানার সেই টুর্নামেন্টের ছিল তিন দল, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর বিশ্ব একাদশ৷ বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডে বড় ধাক্কা লাগে এই টুর্নামেন্টের জেরে৷
ছবি: John Minihan/Hulton Archive/Getty Images
গ্রেগ চ্যাপেল থেকে টনি ক্রেগ
বেতন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় গ্রেগ চ্যাপেলের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা নাম লেখান প্যাকারের টুর্নামেন্টে৷ এমনকি ইংল্যান্ডের অধিনায়ক টনি ক্রেগ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক ইমরান খান, নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি পর্যন্ত যোগ দিয়েছিলেন বিতর্কিত এই সিরিজে৷ মাত্র তিন বছর চললেও দিবারাত্রি ম্যাচ, সাদা বল থেকে শুরু করে আধুনিক ক্রিকেটের অনেক কিছুরই অবদান এই টুর্নামেন্টের৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
ভারতের বৃহৎ ছয়
সময়টা ১৯৮৮৷ অধিনায়ক দিলীপ ভেংসরকারের (ছবিতে) সাথে বিসিসিআই-এর সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ যাচ্ছিল৷ সঙ্গে যোগ দেন কপিল দেব, কিরণ মোরে, অরুন লাল, আজহারউদ্দিন ও রবি শাস্ত্রী৷ ম্যানেজমেন্টকে শর্ত মানাতে বাধ্য করে চুক্তি সই করেন তারা৷ এক বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেয়ায় ছয়জনকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বোর্ড৷ আদালতের মধ্যস্থতায় পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷
ছবি: Simon Bruty/Getty Images
বিতর্কিত কপিল
ভারতের ক্রিকেট গ্রেটদের তালিকায় কপিল দেবের নামটি চোখ বন্ধ করেই আসবে৷ তার হাতেই উঠেছিল দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপাও৷ কিন্তু বিতর্কের পাল্লাটাও কম ভারি নয় কপিলের জন্য৷ খেলোয়াড়ী জীবনে সতীর্থ সুনিল গাভাস্কারের সঙ্গে ‘কথিত’ দ্বন্দ্ব আর খেলা ছাড়ার পরে বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ হিসেবে পরিচিত আইসিএল দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের চক্ষুশূল হয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার৷
ছবি: AP
নির্বাচকরা জোকারের দল!
ভারতের আরেক কিংবদন্তী ক্রিকেটার মহিন্দর অমরনাথ৷ সুনীল গাভাস্কার যাকে ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিহিত করেছিলেন৷ তবে টেস্ট দলে তার জায়গাটা তেমন পাকাপোক্ত ছিল না৷ সব সময়ই থাকতেন আসা-যাওয়ার মধ্যে৷ এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮৮ সালে তিনি ভারতীয় নির্বাচকদের অভিহিত করেছিলেন ‘একগুচ্ছ জোকার’ বলে৷ পরে নিজেও অবশ্য নির্বাচক হয়েছেন৷ বোর্ডের সঙ্গে সেসময় দ্বন্দে জড়িয়ে খবরের শিরোনামও হয়েছেন৷
ছবি: Adrian Murrell/Getty Images
হিথ স্ট্রিক ও সতীর্থরা
দল নির্বাচন নিয়ে প্রতিবাদ ও নির্বাচকদের সমালোচনার জেরে ২০০৪ সালে বরখাস্ত হন জিম্বাবোয়ের অধিনায়ক হিথ স্ট্রিক৷ মাত্র ৩০ বছর বয়সেই খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হন দেশটির বিশ্বমানের এই বোলার৷ তবে স্ট্রিকের বিদায়ের প্রতিবাদ, ন্যুনতম মজুরি ও খোলোয়াড়দের অ্যাসোসিয়েশন গঠনের দাবিতে দরখাস্ত দেন তার ১৫ সতীর্থ৷ পরে তারাও দেশের হয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান৷
ছবি: Graham Chadwick/Getty Images
গেইলদের বিদ্রোহ
২০০৫ সালের স্পন্সর চুক্তির পর থেকেই খেলোয়াড়দের নিয়ে সংকটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড৷ সবচেয়ে বড় তিক্ততাটি তৈরি হয় ২০০৯ সালের বার্ষিক চুক্তির সময়ে৷ ক্রিস গেইল, শিবনারায়ন চন্দরপাল, ডোয়াইন ব্রাভোসহ আরো দশ খেলোয়াড় চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়৷ ফলাফল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনকোরা দল নিয়ে ভরাডুবির শিকার হয় ক্যারিবীয়রা৷ খেলোয়াড়-বোর্ডের এই দ্বন্দ্বে এখনও ধুঁকছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট৷
ছবি: AP
সাম্প্রতিক উদাহরণ
বোর্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক কেভিন পিটারসনের৷ পাওনা নিয়ে খেলোয়াড়দের অ্যাসোসিয়েশন আর বোর্ডের দ্বন্দ্বে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে অচলাবস্থা তৈরি হয় ২০১৭ সালেও৷ পাকিস্তানেও বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের দূরত্ব আছে৷ সবশেষ পেসার আমীর নিজের ক্যারিয়ারের জন্য দুষেছেন বোর্ডকে৷ ১১ দফা দাবিতে সাকিবের নেতৃত্বে ২০১৯ সালে নজিরবিহীন ধর্মঘটের ডাক দেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা৷