অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ওবিন ঠাকুর, ছবি লেখে'৷ ব্রিটিশ এক শিল্পী খাতা-পেন্সিল নয়, পেরেক আর সুতা দিয়ে ছবি আঁকেন৷ তাঁর অনেক শিল্পকর্ম দর্শকদের অবাক করছে৷
বিজ্ঞাপন
তাঁর ছবির দিকে ভালো করে নজর না দিলে মনে হবে, কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে আঁকা৷ কিন্তু মন দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ছবিগুলি আসলে পেরেকে জড়ানো সুতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে৷ পেরেক ও সুতা দিয়ে তৈরি এই সব ছবির স্রষ্টা ব্রিটিশ টেক্সটাইল ডিজাইনার ডেবি স্মিথ৷ তিনি বলেন, ‘‘যখন আর্ট আর ডিজাইন নিয়ে মৌলিক শিক্ষা নিচ্ছিলাম, তখন মনে হয়েছিল, টেক্সটাইল তার নিজস্ব অধিকারে শিল্প হয়ে উঠতে পারে৷ শুধু কোনো কিছু মেরামত করতে সুতা ব্যবহার করা হয়৷ তবে প্রথমেই ছবি সৃষ্টি করার কথা ভাবিনি৷ কিন্তু সামগ্রিকভাবে উপাদান নিয়ে ভাবতে শুরু করি৷ তারপর কলেজে টেক্সটাইল নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি৷ সেখান থেকে আজ এখানে পৌঁছেছি৷''
৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডেবি স্মিথ সুতা-শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন৷ তাঁর শিল্পসৃষ্টির মূল্য ১৮,০০০ ইউরো পর্যন্ত ছুঁয়েছে৷ প্রত্যেকটি চিত্র এমন কোনো মুহূর্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, যা তাঁকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে৷
সৃষ্টির কাজে কত পরিমাণ সুতা ও পেরেক ব্যবহার করা হলো, তা নিয়ে মাথা ঘামান না তিনি৷ ডেবি বলেন, ‘‘আমার কাছে এটা ড্রয়িং৷ অন্যভাবে আঁকা৷ আমি সুতাকে পেন্সিল হিসেবে দেখি৷ প্রথমে সব লাইন তৈরি করে আরও লাইন যোগ করা হয়৷ ঠিক যেভাবে পেন্সিল দিয়ে করা হয়৷
একেবারে নিজস্ব এই শৈলির কারণে অসংখ্য আন্তর্জাতিক কোম্পানি তাঁর কাজের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে৷ তিনি ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ‘অ্যার্মেস'-এর দোকানের জানালার ডিজাইন করেন৷ লন্ডনে ২০১২ সালের অলিম্পিক উপলক্ষ্যে তিনি ‘আডিডাস' কোম্পানির জন্য ডিজাইন করেছেন৷ জার্মানির মার্সিডিজ বেনৎস কোম্পানির জন্য মোবিলিটি সংক্রান্ত একটি স্টাডিরও ডিজাইন করেছেন ডেবি৷
বার্লিনের ‘ইস্ট সাইড গ্যালারির’ ২৯ বছর
১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের ২১টি দেশের ১১৮ শিল্পী বার্লিন প্রাচীরে আঁকতে শুরু করেন৷ সে বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ ১০০-র বেশি দেয়ালচিত্র তৈরি হয়৷ আর এভাবেই জন্ম হয় ‘দ্য বার্লিন ইস্ট সাইড গ্যালারির’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Karin Kaper Film
বার্লিনের প্রতীক
এটা বার্লিনের অন্যতম প্রদর্শিত স্থান৷ জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ নিয়ে অসংখ্য শিল্পী তাদের শিল্প ভাবনার অমর রূপ দিয়েছেন ১ দশমিক তিন কিলোমিটার প্রসারিত এই দেয়ালে৷ তাদের একজন দিমিত্রি ভ্রুবেল৷ মস্কোর এই অপরিচিত আর্ট শিক্ষার্থী ১৯৯০ সালে সাবেক সোভিয়েত এবং তৎকালীন পূর্ব জার্মানির প্রধান লিওনিড ব্রেজনেভ ও এরিশ হ্যনেকার-এর মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ চুমুর এই দেয়ালচিত্রটি আঁকেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ভুক্তভোগীদের স্মরণ
বার্লিন প্রাচীরের তথাকথিত ‘ডেথ স্ট্রিপ লাইন’ এবং ওয়াচটাওয়ারের কাছেই ‘দ্য ইস্ট সাইড গ্যালারির’ অবস্থান৷ সেসময় কাউকে দেয়াল পার হতে দেখলে গুলি করার অনুমিত ছিল পাহারাদার সেনাদের৷
ছবি: Fotolia/creedline
সংরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ
জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের আনুষ্ঠানিক দিন ৩রা অক্টোবরের কয়েকদিন আগে ৯০-এর দশকের ২৮শে সেপ্টেম্বর গ্যালারিটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়৷ তখন থেকেই সেখানকার অনেক দেয়ালচিত্র পোস্টকার্ড আকারে বার্লিনের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হচ্ছে৷
ছবি: DW/Frederike Müller
বিতর্কিত সংস্কার
বার্লিন প্রাচীরের রয়ে যাওয়া অংশকে সারাক্ষণ বাতাস এবং আবহাওয়া মোকাবিলার পাশাপাশি পর্যটকও স্যুভেনিয়ার প্রস্তুতকারীদের খোঁচা সহ্য করতে হয়৷ আর তাই দেয়ালের সংস্কারও জরুরি৷ ২০০৮ সালের অক্টোবরে তাই চিত্রকর্মগুলো পুনরায় পালিশ করার প্রয়োজন হয়৷ কিছু শিল্পী অবশ্য এমনটা করতে রাজি হননি৷ তবে অনেকেই সম্মতি দিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/ Sean Gallup
আর্ট ফ্ল্যাশ মব
জার্মান পপ শিল্পী জিম আভিগনওন ১৯৯০ সালে তাঁর ‘ডুইং ইট কুল ফর দ্য ইস্ট সাইড’ চিত্রকর্মটি তৈরি করেন৷ ২০১৩ সালে তিনি সেই চিত্রকর্মের উপর আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াই কিছু আর্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন করে আঁকেন৷ ফলে চরম সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি৷
ছবি: Reuters
দেয়ালের কিছুটা সরিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা
একটি বহুতল ভবন তৈরির জন্য ২০১৩ সালে ইস্ট সাইড গ্যালারির কিছু অংশ সরিয়ে প্রবেশদ্বার তৈরি করেন বিনিয়োগকারীরা৷ সেসময় বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ হলেও তা সফল হয়নি৷ বর্তমানে ভবনটি তৈরির কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে৷ ২০১৫ সালের প্রথম ছ’মাসের মধ্যে কাজ পুরো শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সময়ের সাক্ষী
যদিও অনেক শিল্পী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিত্রকর্মের যত্ন নিয়েছেন, তা সত্ত্বেও কিছু শিল্পকর্ম অযত্ন অবহেলায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে৷ কোনো কোনো চিত্রকর্মের ওপর আবার গ্রাফিটি আঁকা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Hans Wiedl
রূপালি পর্দায় গ্যালারি
বার্লিন ইস্ট সাইড গ্যালারি নিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছেন জার্মান ফিল্মমেকার কারিন কাপের এবং ডির্ক স্যুসজিস৷ শিল্পী টোমাস ক্লিঙ্গেনশ্টাইন আশা করছেন তথ্যচিত্রটি বার্লিন প্রাচীরের এই অংশটি রক্ষায় ভবিষ্যতে সহায়তা করবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Karin Kaper Film
8 ছবি1 | 8
তাঁর প্রথম বাণিজ্যিক কাজ অবশ্য এসেছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন থেকে৷ তাদের লোগো নতুন করে তুলে ধরাই ছিল তার লক্ষ্য৷ ডেবি স্মিথ বলেন, ‘‘এর আগের কাজের তুলনায় সেটা ছিল একেবারে ভিন্ন৷ কারণ আমি শুধু এভাবে ড্রয়িং করেছি৷ আরও গ্রাফিক, মানে টাইপোগ্রাফি বা হরফ নিয়ে কাজ করা আমার জন্য বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল৷ এর ফলে ভবিষ্যতের জন্যও আরও পথ খুলে গেল৷ কারণ আমার সৃষ্টি আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে গেল৷ কুঁয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকতে চাইনি৷ এই প্রক্রিয়া সীমিত বলে মনে হলেও নানা ভাবে এর প্রয়োগ করা সম্ভব৷''
ডেবি স্মিথ ইংল্যান্ডের পশ্চিমে গ্লস্টাশায়ার শহরে বসবাস করেন৷ শহুরে অঞ্চলেই তিনি অনুপ্রেরণা খুঁজে পান৷ গোটা ইউরোপ থেকে তাঁর জন্য বাণিজ্যিক প্রকল্পের বায়না আসে৷ যেমন ২০১২ সালে ডেবি স্মিথ হামবুর্গ শহরের ফিলহারমোনিক হলের জন্য বিজ্ঞাপনের ডিজাইন করেছিলেন৷ ‘প্রতিটি স্বরলিপিই এক অভিজ্ঞতা' – এই মটোর ভিত্তিতে তিনি একটি সাংগীতিক সৃষ্টিকর্ম দৃশ্যমান করে তুলেছিলেন৷ এই শিল্পকর্ম বেশ আলোড়ন তুলেছিল৷ ডেবি বলেন, ‘‘এটা দেখে অনেকের মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল, কারণ সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল৷''
ডেবি স্মিথ-এর কাজ ভালোই চলছে৷ বলা যেতে পারে, তিনি নিজের কর্মজীবনের বুনট ভালোই গড়ে তুলেছেন৷