কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে নবনির্মিত এক মসজিদের দায়িত্বে আছেন মৌলভি আব্দুল হালিম৷ মাস দুয়েক আগে এই রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছেন৷ পোপ ফ্রান্সিসকে তিনি চেনেন না৷
বিজ্ঞাপন
পোপের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে হালিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘পোপ কে?''
২০ বছর বয়সের আরেক শরণার্থী শামসুন্নাহার ‘পোপ' শব্দটিকে ‘কোক' শব্দের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন৷ আর মোহাম্মদ হাশিম মনে করেছিলেন, পোপ হয়ত একজন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম৷ ‘‘আমরা মিয়ানমারে অন্যান্য নাগরিকের মতো স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চাই৷ আমরা রোহিঙ্গা এবং তাদের উচিত আমাদের স্বীকৃতি দেয়া৷ পোপ কি আমাদের ঘরবাড়ি ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারবেন?'' জানতে চান হাশিম৷
তবে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেকে আছেন যাঁরা পোপ ফ্রান্সিসকে চেনেন৷ মিয়ানমার সফরে পোপ ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ না করায় তাঁদের অনেকে হতাশ৷ এছাড়া বাংলাদেশ সফরে পোপ কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন বলে আশা ছিল তাঁদের৷ যেমন মায়ু আলি বললেন, ‘‘আমি আশা করেছিলাম রোহিঙ্গাদের আসল দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পোপ কুতুপালংয়ে আসবেন৷ তিনি এখানে এলে আমরা প্রতিদিন কীরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা আরও ভালো অনুভব করতে পারতেন৷'' মিয়ানমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন মায়ু আলি৷ কিন্তু ২০১২ সালে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি তিনি৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্প্রতি তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিলে পরিবারসহ মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশে আসেন তিনি৷
রোহিঙ্গা নির্যাতনের দেশ মিয়ানমারে পোপ
ছ’দিনের দক্ষিণ এশিয়া সফরের শুরুতেই মিয়ানমারে গেছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ মানবতাবাদী সব মানুষেরই আশা, তিনি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন৷ তাঁর এ সফর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখবে বলেও আশা অনেকের৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সবার নজর ছিল যেদিকে
মঙ্গলবার সকাল থেকেই সবার নজর ছিল একটি বৈঠকের দিকে৷ মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদ-এ যাচ্ছেন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু ফ্রান্সিস৷ সেখানে নোবেলজয়ী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে তাঁর৷ সবার আশা, গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে মানবতাবাদী পোপ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ইতিবাচক কিছু বলবেন৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সাদর অভ্যর্থনা
৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের দেশ মিয়ানমারে মাত্র ৭ লাখ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানের বসবাস৷ তারপরও সোমবার ইয়াঙ্গনের রাস্তায় নেমেছিল মানুষর ঢল৷ ছবিতে বিমানবন্দরে পোপকে বরণ করে নিচ্ছে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
‘সৌভাগ্য’ উদযাপন
পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানাতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন ক্যাথলিকরা৷ এক ধর্মগুরু জানালেন, তাঁর সঙ্গে মিয়ানমারের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় ১৮’শ ক্যাথলিক এসেছেন ইয়াঙ্গনে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখানে পবিত্র পিতাকে দেখতে এসেছি৷ এমন ঘটনা তো শতবর্ষে একবার ঘটে৷’’
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
সংখ্যালঘুদের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি
মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরাও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে পোপকে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’
এর আগে ইয়াঙ্গনে মিয়ানমারের সব ধর্মের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন পোপ ফ্রান্সিস৷ মিয়ানমারের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের আর্চ বিশপের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় পোপ বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্য, তার গুরুত্ব মনে রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান৷ তবে সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কিছু বলেননি৷
ছবি: Reuters/Osservatore Romano
মানবিক সংকট
রাখাইনে ব্যাপক হারে হত্যা ও ধর্ষণ চালানোর ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘রোহিঙ্গাদের নির্মূল’ করার অভিযোগ তোলে জাতিসংঘ৷ গত আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে মিয়ানমার ছেড়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে যাওয়াদের ধরলে এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে৷ এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া সফরে এলেন পোপ ফ্রান্সিস৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ
সোমবার পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমারে পৌঁছানোর পরই তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের বিতর্কিত সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং৷ এ বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Savitsky
তারপর বাংলাদেশ
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যাবেন ভ্যাটিকানের প্রধান ফ্রান্সিস৷ এছাড়া বাংলাদেশ সফরে তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে যাবেন বলেও আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
8 ছবি1 | 8
পোপ ফ্রান্সিসের অবশ্য ঢাকায় ১৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে৷
কুতুপালংয়ে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মাইগ্রেন্ট অফশোর এইড স্টেশন' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেগিনা কাট্রামবোন আশা করছেন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে পোপ শিবির পরিদর্শনে আসবেন৷ ‘‘পোপের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন না করার কারণ সম্ভবত নিরাপত্তা৷ তবে আমি এখন মনে করি পোপ আমাদের অবাক করে দিয়ে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেবেন৷ তিনি এমন এক পোপ যিনি চমক দিতে পছন্দ করেন,'' বলেন কাট্রামবোন৷
এদিকে, জার্মানি ভিত্তিক রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট নেয় স্যান লুইন মনে করছেন, বার্মার কার্ডিনাল চার্লস মাউং বো'র চাপের কারণে মিয়ানমার সফরে পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছেন৷ তবে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশ সফরে পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করবেন বলে আশা করছেন তিনি৷ নেয় স্যান লুইন এখন বাংলাদেশ সফর করছেন৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷