রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যখন টানাপোড়েন চলছে, ঠিক সেসময় মিয়ানমার সফর করছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ সফরে দেশটির সেনাপ্রধান ও বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে তাঁর৷
বিজ্ঞাপন
পোপ ফ্রান্সিস এমন সময় মিয়ানমার সফর করছেন যখন দেশটির সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ কট্টরপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নিধনের’৷ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷ আগস্টের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে৷ অনেকেই আশা করছেন এই সফরে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তির বাণী ছড়িয়ে ঐক্যের ডাক দেবেন পোপ ফ্রান্সিস৷
পোপ তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’, ‘বাঙালি মুসলমান’ নাকি ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী’ বলে সম্বোধন করেন, সেটার দিকেও তাকিয়ে আছেন অনেকে৷ মিয়ানমারের আর্চবিশপ পোপকে এই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন রোম সফরের সময়৷ মিয়ানমারের সরকার এবং সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন অঞ্চলে অবস্থানরত সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘রোহিঙ্গা’ বলতে রাজি নন৷ পোপ ফ্রান্সিস দেশটির বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করবেন৷ এছাড়া সেনা প্রধান মিন অং লাইং-এর সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে তাঁর৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
মিয়ানমারে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭ লাখ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের মনেও আতঙ্ক বিরাজ করছে৷ মিয়ানমার সম্পর্কিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হোর্সে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারের অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কথা বিশ্বাস করে না এবং তারা এটাও বিশ্বাস করে না যে বাংলাদেশে এত সংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে৷ যদি পোপ এখানে এসে এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তাহলে এখানকার সংকটকে তা আরও উসকে দেবে, এছাড়া জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে৷’’
পোপ ফ্রান্সিস আগামী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সফর করবেন৷ রাজধানী ঢাকায় তিনি কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে৷ বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ৪৫ বছরের রোহিঙ্গা ইমাম নূর মোহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার আশা পোপ মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাবেন এবং আমাদের নাগরিকত্ব দেয়া ও আমাদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানাবেন তিনি৷’’
আগস্টে দেয়া এক বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন পোপ৷ পাশাপাশি সব সম্প্রদায়কে সমান অধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মিয়ানমার সরকারের প্রতি৷
পোপের এই সফরের মূল প্রতিপাদ্য ‘শান্তি এবং ভালোবাসা’৷ সেই লক্ষ্যেই পোপ মিয়ানমারের সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের ডাক দেবেন বলে আশা করছেন মিয়ানমারের আর্চ বিশপ৷ বুধবার একটি পাবলিক মাস এর আয়োজন করা হয়েছে ইয়াঙ্গনে৷
এপিবি/ডিজি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
রোহিঙ্গাদের বর্তমান দিনকাল
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেয়ার-এর ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঘুরে এলেন জেনিফার বোস৷ সেখানকার ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দিনযাপনের ছবি তুলে এনেছেন তিনি৷
ছবি: DW/ P. Vishwanathan
উদ্বাস্তু জীবন
এ বছরের আগস্ট থেকে মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে এসেছে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা৷ এর আগে বিভিন্ন সময়ে যারা এসেছিলেন তারাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাস করছে৷
ছবি: CARE/T. Rahman
শিশুদের অসহায়ত্ব
নির্যাতন, সহিংসতার স্মৃতি গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে রোহিঙ্গা শিশুদের চোখে-মুখে৷ প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার জন শিশু রয়েছে এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে৷
ছবি: CARE/J. Bose
টিকে থাকার সংগ্রাম
স্বল্প পুঁজি নিয়ে ক্যাম্প এলাকার মধ্যেই ব্যবসা শুরু করেছেন এক রোহিঙ্গা ৷ এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গাই দিনমজুরের কাজ থেকে শুরু করে ছোটখাট ব্যবসা করে আয়ের পথ সচল রাখছেন৷
ছবি: CARE/J. Bose
ক্যাম্পজীবন
প্লাস্টিক ঢাকা বাঁশের আচ্ছাদনে দিন কাটছে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের৷ কক্সবাজারের নির্ধারিত ক্যাম্পে গাদাগাদি করে বাস করছে রোহিঙ্গারা৷
ছবি: CARE/J. Bose
বনভূমি উজাড়
কক্সবাজারে পাহাড় ও বনভূমি উজাড় করে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বসতি৷ ক্যাম্প এলাকার আশেপাশের অনেক গাছ এরই মধ্যে উজাড় হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও জ্বালানির প্রয়োজনে৷
ছবি: CARE/J. Bose
অনিশ্চয়তা
পরিবারের সাথে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এই রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম টিকে থাকার প্রয়োজনে৷ অন্যসব অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চিন্তাই বড় হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: CARE/J. Bose
ক্যাম্পে শিশুকাল
মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা নারীদের মধ্যে অন্তত ৫৪ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী রয়েছেন৷ অনেকে ক্যাম্পের আসার পথে বা ক্যাম্পেই জন্ম দিয়েছেন শিশুর৷
ছবি: CARE/J. Bose
নিবন্ধিত রোহিঙ্গা
গত দু’ মাসে নিবন্ধিত হয়েছেন অন্তত ৩ লাখ রোহিঙ্গা৷ ক্যাম্প এলাকায় কয়েকটি কেন্দ্রে চলছে এই নিবন্ধন কার্যক্রম৷
ছবি: CARE/T. Haque
টিকাদান কর্মসূচি
শরণার্থী শিবিরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বয়সের শিশুদের প্রয়োজনীয় টিকা দেয়া হচ্ছে৷ বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধে নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা৷
ছবি: CARE/J. Bose
ত্রাণ সহায়তা
সরকারের আশাবাদ সত্ত্বেও ৬ লাখেরও বেশি নতুন আসা রোহিঙ্গার জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা৷
ছবি: CARE/A. Captain
রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা এতিম শিশুকে পুর্নবাসিত করতে কাজ করছে মনোচিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও চিকিৎসক৷