মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে সফরের বেশিরভাগ সময় ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেননি পোপ৷ কট্টরপন্থিদের কারণে যে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে এই শব্দ এড়িয়ে যাওয়াই উচিত ছিল বলে মনে করেন ডয়চে ভেলের রোডিওন এবিংহাওসেন৷
বিজ্ঞাপন
নামে কি বা আসে যায়? রোহিঙ্গার মানে, এটা কেন ব্যবহার করা উচিত - এ নিয়ে বিতর্ক যেন সংকটের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে৷ পোপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরের আগে থেকেই এ নিয়ে চলছে আলোচনা৷ মিয়ানমারের আদিবাসী সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠী, যাঁরা রোহিঙ্গা নামেই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পরিচিত, তাঁদের পোপ কী বলে সম্বোধন করবেন এ নিয়ে সফরের আগেই চুল চেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায়৷
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কখনোই নাগরিকত্ব দিতে রাজি হয়নি৷ বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে, মোট ১১ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন৷ মিয়ানমার বরাবরই ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছে এবং কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটা না করলে সংকট সমাধানে সরকারের উদ্যোগে ভাটা পড়তে পারে৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
মুশকিল হলো, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কয়েকটি পক্ষ গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই৷ একদল রোহিঙ্গাদের সমর্থনকারী, যেমন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি৷ এই ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী এবং এদের সমর্থকরা ‘রোহিঙ্গাদের রক্ষার' দায়িত্ব নিয়েছে৷ আগস্টের ২৫ তারিখে এই দলটিই রাখাইনের কয়েকটি পুলিশ চৌকিতে হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ৷ আর এর জবাবেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযানে নামে, যার ফলশ্রুতিতে এই সংকটের সৃষ্টি৷
অন্য পক্ষটি হলো অহিংস৷ যেমন রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীরা৷ এই রোহিঙ্গারা গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার৷ মিয়ানমারের রাখাইনে যে গণহত্যা হয়েছে, সে বিষয়ে জনমত গড়ে তুলছেন তাঁরা৷ অনেকেই তাঁদের দেয়া তথ্যকে ভুয়া বলে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও, তাঁরা জনসংযোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন এবং এ বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন৷
তৃতীয় পক্ষ হলো মানবাধিকার কর্মীরা, যাঁরা মনে করেন তাঁদের নীতি মেনে চললে এই সংকট খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব৷ কিন্তু এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস কি তাঁরা জানেন? তাঁরা কি জানেন এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে?
এই তিন পক্ষই কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থন করছে৷ তবে প্রত্যেকেরই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পন্থা ভিন্ন৷ এছাড়া এরা সকলেই চাইছিল যাতে পোপ ফ্রান্সিস ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি ব্যবহার করেন৷
যথারীতি রোহিঙ্গা বিরোধীরা এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন৷ এই বিরোধীদের মধ্যে মিয়ানমারের বৌদ্ধ কট্টরপন্থিরাও রয়েছেন, যারা রোহিঙ্গাদের নিজের দেশের অধিবাসী বলে স্বীকার করেন না৷ অথচ এই রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে আসছেন৷ এই বিরোধীগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনকে অনেকটাই সমর্থন করে এবং তারা রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিম' হিসেবে বরাবরই উল্লেখ করে থাকে এবং তার চেয়েও বেশি ব্যবহার করে ‘বাঙালি' শব্দটি৷
সমস্যা হচ্ছে, যে তৃতীয় পক্ষটির কথা আমি বলেছিলাম, যারা খুব বাস্তববাদী বা কূটনীতিক, এই পক্ষটি রোহিঙ্গাদের প্রতি পশ্চিমাবিশ্বের সহমর্মিতা আদায়ের জন্য রোহিঙ্গাদের যারা ঘৃণা করে, তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করছে৷ ফলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি কমেনি, বরং বেড়েছে৷
সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনান এবং মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিও কিন্তু আজ পর্যন্ত ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেননি৷ তাঁরাও রাখাইনের মুসলিম হিসেবেই রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করেছেন৷ তাঁরা এ জন্যই ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি এড়িয়ে গেছেন, যাতে সব পক্ষের সাথে কথা বলার পথ খোলা থাকে৷
দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশ সফরে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিস অবশেষে ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেছেন৷ এর ফলে রাখাইনে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কিনা বলা যায় না৷ যাই হোক, এই শরণার্থীদের কী নামে ডাকা হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মানবতার খাতিরে এই শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে ফেরার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া৷
রোহিঙ্গা নির্যাতনের দেশ মিয়ানমারে পোপ
ছ’দিনের দক্ষিণ এশিয়া সফরের শুরুতেই মিয়ানমারে গেছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ মানবতাবাদী সব মানুষেরই আশা, তিনি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন৷ তাঁর এ সফর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখবে বলেও আশা অনেকের৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সবার নজর ছিল যেদিকে
মঙ্গলবার সকাল থেকেই সবার নজর ছিল একটি বৈঠকের দিকে৷ মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদ-এ যাচ্ছেন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু ফ্রান্সিস৷ সেখানে নোবেলজয়ী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে তাঁর৷ সবার আশা, গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে মানবতাবাদী পোপ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ইতিবাচক কিছু বলবেন৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সাদর অভ্যর্থনা
৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের দেশ মিয়ানমারে মাত্র ৭ লাখ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানের বসবাস৷ তারপরও সোমবার ইয়াঙ্গনের রাস্তায় নেমেছিল মানুষর ঢল৷ ছবিতে বিমানবন্দরে পোপকে বরণ করে নিচ্ছে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
‘সৌভাগ্য’ উদযাপন
পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানাতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন ক্যাথলিকরা৷ এক ধর্মগুরু জানালেন, তাঁর সঙ্গে মিয়ানমারের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় ১৮’শ ক্যাথলিক এসেছেন ইয়াঙ্গনে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখানে পবিত্র পিতাকে দেখতে এসেছি৷ এমন ঘটনা তো শতবর্ষে একবার ঘটে৷’’
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
সংখ্যালঘুদের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি
মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরাও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে পোপকে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’
এর আগে ইয়াঙ্গনে মিয়ানমারের সব ধর্মের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন পোপ ফ্রান্সিস৷ মিয়ানমারের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের আর্চ বিশপের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় পোপ বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্য, তার গুরুত্ব মনে রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান৷ তবে সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কিছু বলেননি৷
ছবি: Reuters/Osservatore Romano
মানবিক সংকট
রাখাইনে ব্যাপক হারে হত্যা ও ধর্ষণ চালানোর ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘রোহিঙ্গাদের নির্মূল’ করার অভিযোগ তোলে জাতিসংঘ৷ গত আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে মিয়ানমার ছেড়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে যাওয়াদের ধরলে এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে৷ এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া সফরে এলেন পোপ ফ্রান্সিস৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ
সোমবার পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমারে পৌঁছানোর পরই তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের বিতর্কিত সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং৷ এ বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Savitsky
তারপর বাংলাদেশ
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যাবেন ভ্যাটিকানের প্রধান ফ্রান্সিস৷ এছাড়া বাংলাদেশ সফরে তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে যাবেন বলেও আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
8 ছবি1 | 8
রোডিওন এবিংহাওসেন/এপিবি
আপনি কি তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷