বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি নারী হলেও সুপারভাইজার পদে ৯০ শতাংশের বেশি পুরুষ কাজ করছেন৷ এই অবস্থার পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
দেশি, বিদেশি বেসরকারি সংস্থা ও কারখানার মালিকদের উদ্যোগে মেয়েদের নেতৃত্ব পর্যায়ে নিয়ে আসতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷
২০১৩ সালে ডিবিএল গ্রুপের পোশাক কারখানায় কোনো পর্যায়ে কোনো মেয়ে নেতৃত্বে ছিল না৷ আর এখন প্রতি পাঁচ সেলাই লাইনের একটির দায়িত্বে আছেন মেয়েরা৷
২০১৭ সালে ডিবিএল গ্রুপ নারী নেতৃত্বে পরিচালিত ৪২টি দলের উপর এক গবেষণা চালায়৷ এতে দেখা গেছে, ছেলেদের নেতৃত্বে থাকা দলগুলোর চেয়ে তাদের কর্মদক্ষতা তিন শতাংশ বেশি ছিল৷ টাকার হিসেবে সেই লাভের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা৷
ডিবিএল গ্রুপ এখন পর্যন্ত ১০০র বেশি নারীকে সুপারভাইজার পদের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে৷ এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ এখনও ডিবিএল গ্রুপে কাজ করছে৷ বাকিরা ভালো বেতনের প্রস্তাব পেয়ে অন্য কোম্পানিতে চলে গেছেন৷
প্রশিক্ষণ পাওয়া এক নারী শ্রমিক হলেন নুরুন্নাহার বেগম৷ দর্জি হিসেবে কাজ করার চার বছরের মাথায় তিনি প্রশিক্ষণ পেয়ে সুপারভাইজার হয়েছেন৷ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে তিনি বলেন, কাজ শুরুর পর তিনি দেখতে পান কাজ ভালো না করায় কয়েকদিন পরপর পুরুষ সুপারভাইজারদের পরিবর্তন করা হচ্ছে৷ এসব দেখে তিনি সুপারভাইজার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ সেই থেকে তিনি সুপারভাইজার পদে কাজ করছেন৷ নুরুননাহার বলেন, সেলাই লাইনে কাজ করা কর্মীদের বেশিরভাগই মেয়ে৷ তাই তাদের নেতৃত্বে একজন ছেলের চেয়ে একজন মেয়ে থাকা ভালো৷ কারণ অনেকসময় দেখা যায়, মাসিকের কারণে প্রতিমাসে মেয়েদের যে ব্যথা হয় সেটার কথা অনেক মেয়ে তার ছেলে বসের কাছে বলতে না পেরে কারখানায় অনুপস্থিত থাকে৷ এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সমস্যা হয়৷ ‘‘কিন্তু এই অবস্থায় আমি ঐ মেয়েকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেই, কিংবা একটু বিরতি নেয়ার সুযোগ দেই৷ এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক থাকে,'' বলে জানান নুরুন্নাহার বেগম৷
এদিকে দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড রিটার্নস' বা জিইএআর এর মাধ্যমে ৬০টি কারখানায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছে৷ জিইএআর বলছে, তাদের প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী সুপারভাইজারদের নেতৃত্বে থাকা সেলাই লাইনের উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷
জিইএআর এর ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, চাপ মোকাবিলা ও কীভাবে সহকর্মীদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ করা যায় সেসব বিষয় শেখানো হয়৷ এছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি হলে সেটা কীভাবে সমাধান করা যায়, কর্মদক্ষতা কীভাবে মাপা যায় সেসব বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷
জেডএইচ/এসিবি (থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর অবদান
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বাড়ছে৷ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
পোশাক খাত
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোশাক শিল্পখাত থেকে আসে৷ মোট গার্মেন্টসকর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী৷ এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)-র জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার৷ এই খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Biraj
প্রবাসী আয়ে নারী
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন৷ প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম৷ প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ৷ তারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷
ছবি: Imago Images/Zuma/M. Hasan
কৃষিখাত
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষিকাজে নিয়োজিত৷ নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিকাজে৷ বিবিএসের ২০১৮ সালের তথ্য মতে, দেশের কৃষি খাতে নিয়োজিত আছে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
চা শিল্প
চা–শিল্পে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ চা–বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী৷ বাংলাদেশে ২০১৯ সালে নয় কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়৷ চা উৎপাদনের ১৬৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৯ সালে৷ (সূত্র:প্রথম আলো, জুন ২০২০)
ছবি: DW/M. Mamun
শিক্ষা খাত
প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে নারীর জন্য ৬০ শতাংশ কোটা থাকলেও সেই সীমারেখা বেশ আগে অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ৷ তবে মাধ্যমিকে শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ এখনো আশানুরূপ নয়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এই হার নগণ্য৷ (সূত্র: প্রথম আলো)
সেবা খাত
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই খাতে ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী৷ সেবা খাতে ৩৭ লাখ নারী কর্মরত৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নার্স
২০২০ সালে নার্সিং ও মিডওয়াফারি অধিদপ্তরের পিএমআইএস তথ্য অনুযায়ী, দেশে পুরুষ নার্সের সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ৷ অর্থাৎ, ৯০ দশমিক ৬ শতাংশই নারী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পুলিশ
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন৷ তাদের মধ্যে ডিআইজি দুই জন,অ্যাডিশনাল ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০৯ জন ও সহকারি পুলিশ সুপার ১০০ জন৷ এছাড়া ইন্সপেক্টর ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই এক হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং ১২ হাজার ৫৯৪ জন কনস্টেবলও নারী৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP Photo/picture alliance
প্রশাসন
প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী৷ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের হিসেব অনুযায়ী, ১৪৯ জন ইউএনও ছাড়াও বর্তমানে ১০ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ৩৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এবং ১৭৩ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন৷ এছাড়া সচিবের মধ্যে ১১ জন নারী৷ ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে ৮১ জন নারী৷
ছবি: bdnews24.com
কারখানা
২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কারখানায় ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন আর পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন৷
ছবি: Getty Images
জিডিপিতে নারীর ভূমিকা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ৷ এর সঙ্গে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ৷ এর অর্থ হলো, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান সমান সমান৷