নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় এক শিশুর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যার ঘটনায় হতচকিত, বেদনাহত মানুষ৷ তাছাড়া সেখান থেকে আরো ২৭টি শিশু উদ্ধারের ঘটনা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে শিশুশ্রমের ব্যবহারকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ৷
বিজ্ঞাপন
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের ‘জোবেদা টেক্সটাইল মিল'-এর শ্রমিক সাগর বর্মণ নামের ১০ বছরের শিশুটিকে হত্যা করা হয় গত রবিবার৷ অভিযোগ, মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাজমুল হুদা নাকি পায়ু পথে বাতাস ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করে৷ পুলিশ অবশ্য ইতিমধ্যেই নাজমুল হুদাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে৷
তবে মামলার আরো তিনজন আসামি কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার হারুন অর রশিদ, সিনিয়র প্রোডাকশন অফিসার আজাহার ইমাম সোহেল ও সহকারী প্রোডাকশন অফিসার রাশেদুল ইসলাম এখনও পলাতক আছেন৷ তারা এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে৷
সুলতানা কামাল
সাগর তার বাবার সঙ্গে জোবেদা টেক্সটাইল মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো৷ তার মাসিক বেতন ছিল ৩, ৫০০ টাকা৷
সাগরের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকৎসক ডা. এ কে এম শফিউজ্জামান জানান, ‘‘পায়ুপথে বাতাসের পাইপ ঢোকানোর কারণেই শিশু সাগর বর্মণের মৃত্যু হয়েছে৷ তার সমস্ত শরীর ফোলা ছিল৷''
পোশাক কারখানায় অমানবিক নির্যাতন
রূপগঞ্জ থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জসিমউদ্দিন জানান, ‘‘ঐ কারখানায় কর্মরত শিশু শ্রমিকদের নানা অজুহাতে মারধর করা হতো৷ কাজের অবহেলার অজুহাত দেখিয়ে চালানো হতো নির্যাতন৷''
মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিশু হত্যার ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বাংলাদেশে শিশু হত্যা থামছে না৷ এর আগেও নির্মমভাবে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে৷ কিন্তু এ নিয়ে কয়েকদিন হইচই হয়েছে, তারপর সব শেষ৷''
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর রূপগঞ্জ থানার পুলিশ ঐ টেক্সটাইল কারাখানায় অভিযান চালিয়ে আরো ২৭টি শিশুকে উদ্ধার করেছে৷ এদের বয়স ১৩ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে৷ এরা সকলেই ঐ পোশাক কারখনার শ্রমিক বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, কারাখানাটি এখন বন্ধ রয়েছে৷ শিশু হত্যার পর অধিকাংশ শ্রমিক ও কর্মচারী কাজে যোগ দিচ্ছেন না৷
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বন্ধ করা যায়নি
বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ৷ আর পোশাক কারাখানাগুলোতে শিশুশ্রম শুধু নিষিদ্ধই নয়, অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়৷ এ নিয়ে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ও দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে৷ পোশাক কারাখানার মালিকরা শিশু শ্ম নেই বলে দাবি করলেও, রূপগঞ্জের ঘটনায় পোশাক কারাখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ না হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই ধরা পড়েছে৷
এ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘এখানে আইন আছে, প্রয়োগ নেই৷ আর আইন ভাঙলে শাস্তিও হয় না৷ ফলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷''
প্রসঙ্গত, রূপগঞ্জের সাগরের মতো ২০১৫ সালের ৩রা আগস্ট খুলনায় ১২ বছরের শিশু রাকিব হাওলাদারকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়৷ সেই হত্যা মামলায় দু'জনের ফাঁসির হয়েছে৷
মাত্র কয়েক টাকার জন্য
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরকে খনি, কারখানা ও কৃষিখাতের বিভিন্ন চরম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ
১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে৷ সেখানে ১৮ বছরের কমবয়সি শিশু-কিশোরদের শ্রমিক কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়৷
ছবি: imago/Michael Westermann
তোয়ালে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে তোয়ালে তৈরির কারখানায় কাজ করে এই শিশুটি৷ আইএলও-র হিসাবে এশিয়ায় প্রায় সাত কোটি ৮০ লাখ শিশু কাজ করছে৷ অর্থাৎ ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের প্রায় ১০ শতাংশ কাজেকর্মে নিয়োজিত৷
ছবি: imago/imagebroker
দিনে ৬৫ টাকা
লেখাপড়ার পরিবর্তে এই শিশুটি ইট তৈরি করছে৷ চরিম দরিদ্রতার কারণে ভারতের অনেক পরিবার তাদের শিশুদের কাজে পাঠিয়ে থাকে৷ দিন প্রতি মাত্র ৮০ সেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ বাংলাদেশি টাকা পায় তারা৷ এ জন্য তাদের কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়৷
ছবি: imago/Eastnews
সস্তা শ্রম
ভারতের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ শিশু-কিশোর শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে৷ তারা পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে রান্না করা, রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা – সব কাজই করে৷ এমনকি ইট কাটা, মাঠে তুলা তোলা ইত্যাদি কাজও করে থাকে শিশুরা৷
ছবি: imago/imagebroker
অমানবিক অবস্থা
২০১৩ সালে প্রকাশিত আইএলও-র একটি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শিশু শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে৷ তাদের অধিকাংশকেই কোনোরকম চুক্তিপত্র ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘মেড ইন বাংলাদেশ’
জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ-এর হিসাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু-কিশোর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে৷
ছবি: imago/Michael Westermann
কম্বোডিয়ার পরিস্থিতি
কম্বোডিয়ায় স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোরের সংখ্যা অনেক কম৷ বেশিরভাগই তাদের মা-বাবার সঙ্গে কাজ করে৷ এছাড়া হাজার হাজার শিশু রাস্তায় বাস করে কম্বোডিয়ায়৷ এই যেমন এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি
২০০০ সালের পর বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এশিয়ার অনেক দেশ যেমন বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে পরিস্থিতির এখনও ততটা উন্নতি হয়নি৷