শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো তদারকিতে আরএমজি সাসটেইনেবল কাউন্সিল (আরএসসি) গঠনে চূড়ান্ত ঐক্যমতে পৌঁছেছে সব পক্ষ৷
বিজ্ঞাপন
কারখানা মালিক, বিদেশি ক্রেতা ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে ঢাকায় টানা দুদিন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর গত মঙ্গলবার এই কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়৷
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের জোট ইডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল বা আইবিসির নির্বাহী সদস্য জেড এম কামরুল আনাম জানান, আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে আরএসসি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করবে৷ আর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কারখানাগুলোতে পরিদর্শন, সংস্কার পরামর্শ ও অন্যান্য কাজ শুরু করবে তারা৷
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, "আমরা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি৷ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও আমাদের এই সমঝোতায় বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছে৷ নতুন এই কাউন্সিল একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হবে৷ এটি আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকবে৷''
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়৷ তার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ বা অ্যাকর্ড৷ ২০১৮ সালের মে মাসে অ্যাকর্ডের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল৷
একই সময়ে একই লক্ষ্যে গঠিত আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স নির্দিষ্ট সময়ের পর ফিরে গেলেও কাজ শেষ হয়নি বলে আরও তিন বছর সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় অ্যাকর্ড৷ মালিক ও শ্রমিকপক্ষের বিরোধিতার কারণে অ্যাকর্ডের মেয়াদ বৃদ্ধির ওই উদ্যোগ আদালতে গড়ালে অ্যাকর্ড ও বিজিএমইএ যৌথভাবে গত ৮ মে আরও ২৮১ কর্মদিবস কাজ করতে একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করে৷
গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি: অতীত-বর্তমান
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে৷ পোশাক খাতই দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল শিল্প খাত৷ অথচ এই খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবিতে বারবার নামতে হয় রাস্তায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুরুতে মাত্র ৬৩০ টাকা
পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম মজুরি ঘোষণা করা হয়৷ ওই সময় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬৩০ টাকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দশ বছরে বাড়ে ৩০০ টাকা
১৯৯৪ সালে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি করা হয় ৯৩০টাকা৷ এরপর ১২ বছর এই খাতে কোনো বেতন কাঠামো ঘোষিত হয়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. uz Zaman
দুই দশক পর হাজারের ঘরে বেতন!
গত ৪০ বছর ধরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বাইরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আয়ই প্রধান৷ অথচ এই খাতে মজুরি এখনো কম৷ ২০০৬ সালে ন্যূনতম বেতন হাজারের ঘর স্পর্শ করে৷ ১৯৯৪ সালের ঘোষিত ৯৩০ টাকা ২০০৬ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু অপ্রতুল
২০১০ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় তিন হাজার টাকা৷ কিন্তু তখন ন্যূনতম ৮ হাজার টাকার দাবি ছিল শ্রমিকদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০১৩ সালেও প্রত্যাশার চেয়ে কম
২০১৩ সালের জুন মাসে গঠিত মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের মূল মজুরি নির্ধারণ করে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা৷ দ্রব্যমূল্য বাড়লেও শ্রমিকরা ২০১০ সালের দাবি অনুযায়ীও মজুরি পায়নি৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
২০১৮ সালে ১১ গ্রেডের বেতন কাঠামো
গত বছর নতুন করে পোশাক শ্রমিকদের বেতনের ১১টি গ্রেড করা হয়৷ এর মধ্যে শ্রমিকদের জন্য সাতটি ও কর্মচারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয় চারটি গ্রেড৷ শ্রমিকদের প্রথম গ্রেডে মজুরি ধরা হয় ১৭ হাজার ৫১০ টাকা৷ এর মধ্যে শিক্ষানবিশ গ্রেডও রয়েছে৷ শিক্ষানবিশ শ্রমিকরা মাসে পাঁচ হাজার ৯৭৫ টাকা পাবেন৷
ছবি: bdnews24.com
কী হয় এ বেতনে!
শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে আট হাজার টাকা৷ এর মধ্যে মূল মজুরি চার হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া দুই হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা৷ তবে বলা বাহুল্য, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে ন্যূনতম মজুরি বা বর্তমান মজুরি কাঠামোকে পোশাক শ্রমিকরা সঙ্গতিপূর্ণ মনে করছেন না৷
ছবি: Taslima Akhter/Hygienemuseum Dresden
টাকার অংকে মজুরি বেড়েছে মাত্র ২৭১ টাকা
বাংলাদেশ মজুরি বোর্ডের আইন অনুযায়ী মূল মজুরি প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ে৷ পাঁচ বছর পরপর মজুরি কাঠামো পর্যালোচনার আইনও রয়েছে৷ সে অনুযায়ী সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকদের ২০১৩ সালের মূল ছিল ৩ হাজার ৮২৯ টাকা৷ আর এখন নতুন মূল মজুরি ঘোষিত হলো ৪ হাজার ১০০ টাকা৷ অর্থাৎ, এই গ্রেডের মজুরি বেড়েছে ২৭১ টাকা মাত্র!
ছবি: bdnews24.com/M.Z. Ovi
অন্য খাতের মজুরি
২০১৮ সালে চামড়া খাতে নতুন যে মজুরি কাঠামো ঘোষিত হয়েছে তাতে সর্বনিম্ন গ্রেডের শ্রমিকদের মোট মজুরি ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা৷ শিপব্রেকিং খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ১৬ হাজার টাকা৷ অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যানামেল শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার ৭০০ টাকা৷ পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি তার চেয়ে অনেক কম৷