যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতাদের সমন্বয়ে গঠিত পোশাক কারখানা পরিদর্শন জোট ‘অ্যালায়েন্স’ গত এক বছর কারখানা পরিদর্শন করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে৷ পোশাক খাতের উন্নয়নে সংস্থাটি এই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এই কথা জানানো হয়েছে৷ এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অ্যালায়েন্সের এক বছরের কার্যক্রমের পর্যালোচনা নিয়ে সম্প্রতি একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ ঐ বৈঠকে অ্যালায়েন্সের প্রধান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেস সদস্য অ্যালেন টসার বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের উন্নয়নে অ্যালায়েন্স গঠনের পটভূমি তুলে ধরেন৷ এসময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জর্জ মিশেল, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের শ্রমিক নেতাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন৷
বৈঠকে অ্যালেন টসার বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, গত এক বছরে এই জোটের কার্যক্রমে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে৷ তাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, শতভাগ কারখানা (৫৮৭টি সবগুলো) ইতিমধ্যে পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে৷ এর মধ্যে অর্ধেক কারখানার সংস্কার কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে৷
পরিদর্শনের সময় ঝুঁকি বিবেচনায় ১৪টি কারখানা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের বেতনের অর্ধেক অংশ অ্যালায়েন্স পরিশোধ করেছে৷
আগের কথা
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের সমালোচনার প্রেক্ষিতে অ্যামেরিকাভিত্তিক ২৬টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি' – সংক্ষেপে যেটা অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত৷ জোট গঠিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে জোটের সদস্যদের অর্ডার সরবরাহ করে এমন বাংলাদেশি কারখানা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়৷ সেই সঙ্গে ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় ৫ বছরের জন্য কারখানা সংস্কারে একটি তহবিলও গঠন করা হয়৷
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি
২৪শে এপ্রিল, ২০১৩৷ সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছের সুউচ্চ ভবন ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ল বিকট শব্দে৷ ধসের আশঙ্কাকে আমলে না নেয়ার পরিণাম ১,১৩৫ জন পোশাক শ্রমিক, করুণ মৃত্যু৷ আহত এক হাজারেরও বেশি মানুষের এখনো দিন কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাঁচা আর বাঁচানোর লড়াই
ভবন মালিক সোহেল রানার অর্থলিপ্সার নির্মম শিকার পোশাক শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকেননি সাধারণ মানুষ৷ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসে একরকম খালি হাতেই অনেকে নেমে পড়েন উদ্ধার কাজে৷ নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে বহু পোশাক শ্রমিককে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters
অসহায়ত্ব
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকলেও, ঘটনাস্থলে উদ্ধারকর্মীর কমতি ছিল না৷ তবুও অনেকেই চলে গেছেন স্বজনদের কাঁদিয়ে৷ এ ছবির মতো অবস্থাতেও উদ্ধার করতে হয়েছে অনেক মৃতদেহ৷ ৮০০-রও বেশি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা গেলেও, অনেকের পরিচয় আজও জানা যায়নি৷ কিছু লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে৷ কিন্তু ৮৭ জনের জন্য নতুন করে নমুনা চাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রেশমার ফেরা
রানা প্লাজা ধসের ১৭তম দিনে ঘটে বিস্ময়কর এক ঘটনা৷ ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আর কাউকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব নয় ভেবে সাধারণ উদ্ধারকারীদের অনেকে যখন ঘরে ফিরছেন, তখনই প্রায় সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২২ বছর বয়সি পোশাক শ্রমিক রেশমাকে৷
ছবি: Reuters
এখনো কাঁদে প্রাণ
ধসের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন অনেকে৷ বিজিএমইএ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা৷ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে ঠিকই, তবে বিতরণ করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা৷ ভবন ধসের বর্ষপূর্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে শোনা গেছে হতাশা আর ক্ষোভের কথা৷ পপি বেগমকে কেড়ে নিয়েছে রানা প্লাজা৷ ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবর জিয়ারত করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন বোন রোজিনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মায়ের কান্না
জুরাইন কবরস্থানে রশিদা খাতুনের কবরের পাশে সফুরা খাতুন৷ ভবন ধসের প্রায় দশ মাস পর, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন সন্তানের লাশ খুঁজে পাওয়ার সান্ত্বনা৷
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে মূলত তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই এসেছিলেন৷ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তিতে আয়োজন ছিল অনেক, তবে জুরাইন কবরস্থানে ভিড় ছিল না তেমন৷ সেখানে এভাবেই হারানো স্বজনের ছবি হাতে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছিলেন এক নারী৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসের ছবি নিয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ৬০ জন আলোকচিত্র সাংবাদিকের তোলা ছবি স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ফুলের জলসা
রানা প্লাজা ধসে নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মোনাজাত
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি ‘অ্যাকর্ড' নামে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতাদের সমন্বয়ে গঠিত আরেকটি জোটও কারখানা পরিদর্শন কার্যক্রম চলমান রেখেছে৷
অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য শুরুতেই প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল গঠন করেছিল৷ এর বাইরে কারখানা ভবন সংস্কারে আরো ১০ কোটি ডলার স্বল্প সুদে ঋণ তহবিল এবং সম্প্রতি আরো কয়েকটি কোম্পানি মিলে আরো ২ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে৷ এই তহবিল থেকে আগামী ৫ বছর কারখানা ভবন সংস্কারে উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে৷
আরও কারখানা বন্ধের আশঙ্কা
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য মতে, সাব-কন্ট্রাক্টিং করে এমন কারখানাগুলো ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ আসছে ঈদের পরও এমন অনেকগুলো কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ গত বছর রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর প্রায় ৪ শতাধিক ছোট গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷
তবে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের বিষয়ে কমপ্লায়েন্স ইস্যুর চেয়ে মালিকরা বাড়তি উৎপাদন খরচ এবং পোশাকের দাম বৃদ্ধি না হওয়ার কারণকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন৷ তাঁদের মতে, কমপ্লায়েন্স করতে যেমন খরচ বাড়ে, তেমনি বর্ধিত মজুরি প্রদান এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরতে গিয়ে টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে৷ যে কারণে মালিকদের অনেকেই এদিকে নজর দিচ্ছে না৷ ফলে স্বল্প পুঁজি ও ছোট পরিসরে গড়ে উঠা কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না৷
রানা প্লাজায় আহতদের সহায়তায় জার্মানিতে প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসে আহত পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় জার্মানির বিলেফেল্ড শহরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ একটি গির্জায় আয়োজিত এই প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হবে আহত শ্রমিকদের সহায়তায়৷
ছবি: DW/A. Islam
বিলেফেল্ডে প্রদর্শনী
জার্মানির বিলেফেল্ড শহরের একটি গির্জায় ২৬ জানুয়ারি প্রদর্শন করা হয় একদল পোশাক শ্রমিকের ছবি, যাঁরা রানা প্লাজা ধসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত৷ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য, ২০১৩ সালের ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এ সব মানুষ সম্পর্কে জার্মানদের জানানো৷ পাশাপাশি তাঁদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ৷
ছবি: DW/A. Islam
শুধু ছবি নয়
বিলেফেল্ডে গির্জার পাশের সম্মেলন কক্ষে পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন ছবির পাশেই শোভা পাচ্ছিল কিছু টি-শার্ট৷ সাদা এই টি-শার্টের উপরে লেখা রয়েছে ‘ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন’৷
ছবি: DW/A. Islam
উৎসুক দৃষ্টি
একটি ছবির ক্যাপশনের দিকে প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের উৎসুক দৃষ্টি৷
ছবি: DW/A. Islam
ছিলেন বাঙালিরাও
বিলেফেল্ডে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছবি প্রদশনীটি দেখতে গির্জায় হাজির হন৷ সাভারে পোশাক শ্রমিকদের করুণ পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত তাঁরা৷
ছবি: DW/A. Islam
গির্জার ভেতরে
গির্জায় রবিবার প্রার্থনা সভা চলাকালে বাংলাদেশের এই ছবিটিসহ আরো কয়েকটি ছবি প্রদর্শন করা হয় প্রার্থনা কক্ষের ভেতরেই৷ বাংলাদেশ সম্পর্কে জার্মানির আমজনতাকে ধারণা দেওয়ার ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ স্থানীয় গণমাধ্যমেও সাড়া জাগিয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
আয়োজকের কথা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে স্বেচ্ছাসেবী ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷ ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা জানতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন তিনি৷ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারোশ’র বেশি মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হন, যাঁদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক৷
ছবি: DW/A. Islam
অর্থ যাচ্ছে স্নেহা ফাউন্ডেশনে
ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন জানান, প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ স্নেহা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় খরচ করা হবে৷ ফাউন্ডেশনটি ৩০ জন নারী পোশাক শ্রমিকের দীর্ঘমেয়াদি পুর্নবাসনের দায়িত্ব নিয়েছে, যাঁরা ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মা৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ'র এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ কারখানাই শেয়ারড ভবনে (গার্মেন্টস কারখানার পাশাপাশি অন্য কার্যক্রমও চলে এমন ভবন) এবং সাব-কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে কাজ করত৷ কিন্তু বন্ধ হওয়া এসব কারখানার শ্রমিকদের বেতনভাতাদি অপরিশোধিতই রয়ে যাচ্ছে৷
বিজিএমইএ'র হিসাবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে ২০৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে৷ এর বাইরে বিকেএমইএ'র সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর মধ্য থেকে আরো ১৯৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কর্মকর্তারা৷
শ্রমিক বিক্ষোভ
সম্প্রতি আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার সোনিয়া ফাইন নিট নামে একটি কারখানার শতাধিক শ্রমিক রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনের সামনে পাওনা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন৷ কারখানার মালিক এনায়েত উদ্দিন মাহমুদ কায়সার ডয়চে ভেলেকে বলেন, আইন মেনেই ঐ কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে৷ শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা অন্যায্যভাবে পিস রেট বাড়ানোর দাবি করছিল৷ কারখানা চালু রাখার বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই৷ শেষ পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শ্রমিকরা সকালে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যাবে আর মাস শেষে তাদের বেতন দিতে হবে৷ এভাবে তো আর কারখানা চালু রাখা যায় না৷