বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে৷ এই বিতর্ক দুই ক্রেতা গ্রুপের মধ্যে৷ আর তাদের বিতর্কে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকরা৷
বিজ্ঞাপন
তাঁরা বলছেন, দুটি ক্রেতা গ্রুপের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় একই কারখানা একাধিকবার পরিদর্শন করা হচ্ছে৷ বিজিএমইএ বলছে, বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোটের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ফলে একই কারখানা দু'পক্ষ থেকেই পরিদর্শনের ফলে মালিকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন৷ বিষয়টি অ্যালায়েন্স স্বীকার করলেও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড বলছে তালিকা ও মানদণ্ড মেনেই কাজ করছেন তাঁরা৷
রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর দেশের ৩,৫০০ পোশাক কারখানা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হয়৷ এর মধ্যে ১,৫০০ ইউরোপীয় জোট অ্যাকর্ড এবং ৬০০ পোশাক কারখানা অ্যামেরিকান জোট অ্যালায়েন্সের তালিকায়৷ বাকি কারখানাগুলো পরিদর্শন করার কথা সরকারের৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
তবে ক্রেতাদের দুপক্ষ থেকেই একই কারখানা একাধিকবার পরিদর্শনের নজির রয়েছে৷ জানা গেছে মোট ৩০০ কারখানা দুইবার করে পরিদর্শন করা হয়েছে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আশুলিয়ার জিরানি বাজারে বডিস্ট্রেচ কারখানা পরিদর্শন করে অ্যাকর্ড৷ এর আগেই এটি পরিদর্শন করে অ্যালায়েন্স-মনোনীত কোম্পানি ব্যুরো ভেরিটাস৷ অ্যাকর্ড বলছে, সঠিক মানদণ্ড তৈরি হবার আগেই বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে একবার কারখানাটি পরিদর্শন করা হয়৷ মানদণ্ড তৈরির পর তালিকায় থাকায় তাই কারখানাটিতে আবারও যায় অ্যাকর্ড৷
ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড বলছে তারা তাদের এরই মধ্যে ১,০৭৫টি কারখানা পরিদর্শন করেছে৷ তারা পরিদর্শন করা কারাখানার মধ্যে কিছু কারখানা আবারো পরিদর্শন করতে চায়৷ তারা বলছে, তাদের আরো কিছু বিষয় দেখার আছে৷ এখনো তাদের উদ্বেগের যে বিষয়গুলো আছে সে সব ব্যাপারে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান৷ আর মানদণ্ড ঠিক করার আগেই এককভাবে ক্রেতারা যে সব কারখানা পরিদর্শন করেছে সেগুলোও পরিদর্শন করা প্রয়োজন৷
তবে অ্যামেরিকান জোট অ্যালায়েন্স বলছে, তারা এ পর্যন্ত তাদের তালিকায় থাকা ৬০০ কারখানার পরিদর্শন শেষ করেছে এবং তাদের নতুন করে কারখানা পরিদর্শনের দরকার নেই৷ তাদের পরিদর্শনের পদ্ধতি নিয়ে অ্যাকর্ড যে প্রশ্ন তুলেছে, তা তারা মানতে নারাজ৷
বিজিএমইএ-র সহ সভাপতি শহীদুল আযিম জানান, দুই গ্রুপের মধ্যে পোশাক কারখানা পরিদর্শন নিয়ে এই সমন্বয়হীনতা এবং বিতর্কের কারণে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ এতে কারখানার উৎপাদন যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন খরচও বেড়ে যাচ্ছে৷ তিনি বলেন, এটা বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করছে৷ তাই তিনি ক্রেতাদের দু'টি গ্রুপকে সমন্বয় করে কাজ করার অনুরোধ করেছেন৷
উল্লেখ্য এখন পর্যন্ত ১,৬০০ পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে ২১টি বন্ধের সুপারিশ করেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স৷ ২১টি কারখানাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷