করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল৷ বিভিন্ন দেশে নতুন লকডাউনে আবারও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা৷ তবে সেটি আগের মতো বড় আকারে হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: AFP/M. U. Zaman
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২৩ শতাংশ কমে যায়৷ দেশে দেশে করোনার লকডাউনের কারণে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়৷ ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জমে পোশাকের স্তুপ৷ এতে অনেক ব্র্যান্ড কারখানাগুলোর আগের কার্যাদেশ বাতিল করে, অনেকে দামও কমিয়ে দেয়৷
সিপিডির সম্মানিত ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান শনিবার প্রকাশিত তার এক গবেষণা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, এই সময়ে পোশাক শ্রমিকদের আয় কমেছে আট শতাংশ৷ তবে পোশাক খাতে গত এপ্রিলে অনিশ্চয়তা ৩৬ শতাংশ থাকলেও সেপ্টেম্বরে তা কমে চার শতাংশ হয়েছে৷
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে নতুন করে পোশাক খাতে রপ্তানি আদেশ কমার চিত্র মিলছে৷ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আদেশ ছিলো ৪৩ কোটি ডলারের৷ নভেম্বর মাসে তা কমে হয়েছে ৪২ কোটি ডলার৷ এক মাসের ব্যবধানে শতকরা তিন ভাগ রপ্তানি আদেশ কমেছে৷ রপ্তানির জন্য তৈরি পোশাক খাতের এলসি বা ঋণপত্র খোলার পরিমানও কমেছে৷
আরশাদ জামাল দিপু
This browser does not support the audio element.
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, প্রথম ঢেউয়ের অভিঘাত পোশাক খাত কাটিয়ে উঠলেও তা ছিলো সাময়িক৷ সংগঠনটির সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল দিপু বলেন, ‘‘ঠিক আজকের (রবিবার) কথা যদি বলি তাহলে আমাদের অর্ডার হোল্ড (কার্যাদেশ স্থগিত) হওয়ার পরিমান শতকরা ২৪ ভাগ৷ এই মাস থেকেই দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে৷ পুরো চিত্রটা এপ্রিল-মে মাসে পাওয়া যাবে৷ কারণ তিন মাস আগে অর্ডার পাওয়া যায়৷ তাই এপ্রিল-মে মাসে গিয়ে শতকরা ৩০ ভাগ অর্ডার হারানোর আশঙ্কা আছে৷’’
তবে করোনার প্রথম ধাক্কার মতো এই প্রভাব ততটা প্রকট হবে না বলে মনে করেন সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম৷ তিনি জানান, গত এপ্রিলে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ৮২ শতাংশ কমেছিল৷ জুন মাসে কমেছে প্রায় ৬২ শতাংশ৷ সেখান থেকে আবার সাম্প্রতিক সময়ে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছিলো৷ কিন্তু এখন আবার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে৷ তবে এর মাত্রা অনেক কম৷ কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপে লকডাউন প্রথম ঢেউয়ের মত নয়, কিছু কিছু এলাকায় করা হচ্ছে সীমিত আকারে৷ ফলে কেনাকাটা বন্ধ হয়ে যায়নি৷ পোশাকের মূল বাজার ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে৷ আমরা ধারণা এটা সফল হলে মানুষ সহজে চলাচল করবে, কাজ করবে, কেনাকাটা করবে৷ ফলে আমাদের দেশের পোশাকের চাহিদা সেরকম কমবে না৷’’
মোটা দাগে বাংলাদেশে দুই ধরনের পোশাক রপ্তানি করে, ওভেন ও নিট৷ এর মধ্যে ওভেন অর্থাৎ জামা-কাপড়ের বড় বাাজার যুক্তরাষ্ট্র৷ তাই পুরো পোশাক শিল্প প্রথম ঢেউ কাটিয়ে উঠলেও ওভেন রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় ছিলো৷ দেশটিতে বিস্তৃত পরিসরে টিকা কার্যক্রম চালু করতে নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেসব উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন তাতে সামনের দিনে সেখানে পোশাক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘পোশাক খাত নতুন বাজার পাচ্ছে৷ নতুন ধরনের সক্ষমতাও অর্জন করেছে৷ তবে ভ্যাকসিনেশন কতটা সফল হয় তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে৷’’ তার মতে, পোশাকের জন্য এখন অনলাইন বাজার গড়ে উঠেছে৷ নতুন বাজারও তৈরি হচ্ছে৷ সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ তেমন ক্ষতি করতে পারবে না৷
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
This browser does not support the audio element.
তবে এই বিষয়ে ততটা আশ্বস্ত নন আরশাদ জামাল দিপু৷ এই উদ্যোক্তার মতে, ‘‘ভ্যাকসিনেশন সফল হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে৷ কিন্তু ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডে এটা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে৷ আর ভ্যাকসিনের সাইকেল আছে৷ ফলে পুরো কনফিডেন্স ফিরে আসতে আরো কমপক্ষে দুই মাস লেগে যাবে৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে৷’’
দিপু জানান, তারা গত সপ্তাহে করোনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি জানিয়েছেন৷ নতুন করে প্রণোদনা চেয়েছেন৷ তবে সরকার নতুন প্যাকেজে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছে৷
রবিবার সরকার কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার নতুন দুইটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে৷
‘‘প্রণোদনাসহ নানা দিক দিয়ে বড় পোশাক কারখানা বিপর্যয় অনেকটা কাটিয়ে উঠলেও এখন ছোট কারখানাগুলোর জন্য প্রণোদনা দরকার,’’ বলেন গোলাম মোয়াজ্জেম৷
করোনা ভ্যাকসিনের যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অনেক দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি নিয়ে এখনও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
সাধারণ প্রতিক্রিয়া
যেকোন টিকারই সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে৷ যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেয়ার স্থানটি লাল হয় বা ফুলে যায়৷ তিনদিনের মধ্যে অবসাদ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাথা হতে পারে৷ তবে এর কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mark Lenninhan/AFP/Getty Images
গুরুতর প্রতিক্রিয়া
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে৷ যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়৷ দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে সতর্ক করেছে৷ তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার বিভিন্ন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
টিকার উপাদান
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে৷ যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে৷ তবে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এতে কোন ভাইরাস থাকে না৷ তার বদলে কোভিড-১৯ এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে৷ তাই দুই ধরনের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দুই রকম হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
বায়োনটেক-ফাইজার
অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথা ব্যাথায় ভুগেছেন৷ এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুইজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে বিট্রিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি৷
ছবি: Jacob King/REUTERS
মডার্না
বায়োনটেক-ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি৷ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকাগ্রহীতাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি৷ হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক৷ তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল৷ অল্প কয়েকজন রোগী অ্যালার্জি ও মুখের স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন৷ তবে কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: Dado Ruvic/Reuters
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন৷ সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল৷ কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়৷ এছাড়া টিকাটি নেয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যাথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki
স্পুটনিক ফাইভ
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর আগে গত আগস্টেই নিজেদের টিকা স্পুটনিক ফাইভ এর অনুমোদন দেয় রাশিয়া৷ দুই ধরনের পরিবর্তিত অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এতে৷ রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, মাথাব্যাথার মতো টিকাটির কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তবে কোন গুরুতর প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
ছবি: Sergei Karpukhin/TASS/dpa/picture alliance
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনটিই আসলে পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে না৷ দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা৷ সেটি হয়ত সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিস্কার হবে৷