বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারাখানা গত ৬ মাসে ১১ কোটি ডলারের কার্যাদেশ হারিয়েছে৷ আরো কার্যাদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ৷ এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে পোশাক কারখানার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিজিএমইএ-র সভাপতি আতিকুল ইসলাম জানান, ‘‘৫৭টি পোশাক কারখানা থেকে গত ৬ মাসে ১১ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে৷ সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় ২০ কোটি পিস পোশাক৷''
তিনি জানান, ‘‘যেসব কারাখানার নিজস্ব ভবন নেই, অন্য ভবনে বা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কারখানা চালাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে ব্যবসা গুটাচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান৷'' ৪১৯টি কারখানায় জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা এই কার্যাদেশ বাতিল করেছে, তারা পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্সের সদস্য৷ এ সব প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছর বাংলাদেশে ব্যবসা করার প্রতিশ্রতি দিয়েই অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চুক্তি করেছে৷'' তবে কৌশলগত কারণে কার্যাদেশ বাতিল করা কোনো ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি৷
বিজিএমইএ-র সভাপতি অভিযোগ করেন, ‘‘অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্সের কাছে এই বিষয়ে সুরাহার আবেদন জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না৷'' তিনি জানান, ‘‘পোশাক শিল্পের ৪০ শতাংশ কারখানাই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে৷ আর এ সব কারখানায় শতকরা ১৫ ভাগ শ্রমিক কাজ করেন৷ এভাবে কার্যাদেশ বাতিল হলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবেন৷'' তাই ক্রেতাদের তিনি বলেন, ‘‘এখনই এ সব কারখানা একক বা নিজস্ব ভবনে স্থানান্তর সম্ভব না৷ সেজন্য অবশ্যই মালিকদের সময় দিতে হবে৷''
বিজিএমইএ-র সভাপতি বলেন, ‘‘অ্যার্কডের পরিদর্শন কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত ১৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷ অনেক শ্রমিক বেকার হয়েছেন৷ তবে ঐ সব কারখানায় যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাকের কাজ করায়, তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি৷ এ ব্যাপারে ক্রেতাদের দুই জোটের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷''
বিজিএমইএ-র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কার্যাদেশ বাতিল করার তালিকায় ছোট-বড় সব ধরনের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড আছে৷ ক্রেতারা কৌশল করছে৷ কার্যাদেশ বাতিল করলেও তারা এর পেছনের সঠিক কারণ উল্লেখ করছে না৷ কারণ, এতে করে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়ার সম্ভাবনা আছে৷'' তিনি জানান, ‘‘কার্যাদেশ বাতিলের এই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে, আর পোশাক কারখানার মালিকরাও ভবিষ্যতের আশায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে চাইছে না৷ কিন্তু গত ছয় মাসের রপ্তানি বিপর্যয় দেখলেই তা বোঝা যাচ্ছে৷''
গত বছরের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১,১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং এর আগে তাজরিন ফ্যাশানস-এ আগুনের ঘটনায় শ্রমিক নিরাপত্তা এবং নিম্ন মজুরি নিয়ে চাপের মুখে পড়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প৷ নিরাপত্তা, কম মজুরি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা প্রশ্নে পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ তারা ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় চলে যাচ্ছে বলে জানা যায়৷
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ৷ রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে এই খাত থেকে৷ পোশাক কারখানায় নিয়োজিত আছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাঁদের ৮০ ভাগই নারী৷ তাই পোশাক কারখানার এ ধরনের বিপর্যয় পুরো অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলবে৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?