1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পোশাক নিয়ে নারীর ‘স্বাধীনতার' লড়াই বনাম ‘সমাজের’ নজরদারি

তাহসিনা ইসলাম
৯ অক্টোবর ২০২৪

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্ট ছিল এরকম, ‘‘আমরা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ চাই যেখানে শুধু বাঙালি মুসলমান পুরুষ বসবাস করবে৷''

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি: Johny Hoque/DW

লেখাটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎ করে বাংলাদেশে এমন কী হয়েছে যে এমন বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লো?

এই বক্তব্যের মাধ্যমে 'ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ'-এর ধারণা এবং কে বা কারা সেখানে বসবাস করবে, এ দুইটি বিষয় স্পষ্ট হয়। আমরা যদি একটু ঘুরেফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা চায়ের আড্ডায় বসি, তাহলে এই দুইটি বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পেতে পারবো। আর এই ধারণা মূলত গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের বিভিন্ন আলোচনা থেকেই পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের ধারণাটি আবার আলোচনায় এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে সবার বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পোশাকের স্বাধীনতা, সংস্কৃতিসহ সবকিছুই থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, নানাভাবে নানা গোষ্ঠী, ব্যক্তি এই ‘ইনক্লুসিভ' ধারণা থেকে বের হয়ে আসছেন। যদিও তারা আন্দোলনে এই ধারনার পক্ষেই কথা বলেছিলেন। তারা তাদের নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে এবং চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন অন্যের উপরে। যা অনেকটাই বিগত ১৫ বছর ধরে চলে আসা আওয়ামীলীগ সরকারের ধারণার মতো। এখন আসা যাক  দ্বিতীয় বিষয়টিতে- শুধু বাঙালি পুরুষ মুসলমানের কথা কেন বলা হয়েছে! এই পুরুষ মুসলমান কারা, সেটির তাৎপর্য বুঝলে অনেকেই হয়তো বুঝে যাবেন কী ধরনের মতামতগুলো চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের আধিপত্য বা নীতিগত পার্থক্যের ধারণা তৈরি হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে পোশাকের স্বাধীনতা খর্ব করা। বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও তাদের পোশাক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় মতামত পোষণ করছেন এসব গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা।

খুব সম্প্রতি ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে আমার চোখ আটকে যায় একটি মন্তব্যে: "The irony when a half naked person says that”/ আশ্চর্যজনক হলো যখন ‘‘একজন অর্ধনগ্ন মানুষ এটা বলে”, আমার অ্যামেরিকায় অবস্থানরত বান্ধবীর এলজিবিটিকিউ-এর বিপক্ষের একটি পোষ্টে অধিকাংশ মানুষের কমেন্টই ছিল অনেকটা একইরকম। তার পোস্টের বিষয়বস্তু নিয়ে অন্য তর্কে যাওয়া যেতেই পারে, তবে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘‘অর্ধনগ্ন মানুষ কি কথা বলতে পারবে না? কথা বলার অধিকারও কি এখন পোশাকের পরিপূর্ণতার ওপর নির্ভর করছে? আর সেই পরিপূর্ণ পোশাকটাই বা কী? কে ঠিক করে দেয়?''

পোশাক কি স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও নির্ধারণ করে? যখন একজন নারী নিজের কথা বলে, তখন কি তার বক্তব্যের আগে তার পোশাক বিচার করতে হবে? ‘পরিপূর্ণ পোশাক' না থাকলে তার কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না?

নারীদের পোশাক নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধাক্কা আসে কক্সবাজারের একটি ঘটনায়। যেখানে মুহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম নামে এক যুবকের নেতৃত্বে একদল লোক সমুদ্র সৈকতে নারীদের উপর আক্রমণ ও অপমান করে, তাদের পোশাককে ‘অশালীন' বলে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

চলতি মাসের শুরুতেই চলচ্চিত্র পরিচালক অপারাজিতা সংগীতা তার ফেসবুক ওয়ালে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে দেখা যায় তার গাড়ির জানালার কাচে একজন বয়স্ক ব্যক্তি থুতু দিচ্ছেন। ভিডিওর ক্যাপশনে অপরাজিতা সংগীতা জানান, তার জামার সাথে ওড়না ছিল না বলে লোকটি অনেকক্ষণ ধরে তাকে বাজে কথা বলেছে, শেষ পর্যন্ত চলে যাওয়ার আগে তার গাড়িতে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে। চরম হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে সংগীতা লিখেছেন, ‘‘এত সাহস, এত সাহস বেড়েছে এদের।''

আমরা যদি একটু ফিরে তাকাই, তবে দেখতে পাবো ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে টিএসসি এলাকায় তার পোশাকের কারণে কিছু বখাটে যুবক হয়রানি করে এবং তাকে মানসিকভাবে হেনস্থা করে। ২০২৩ সালে ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মলে এক নারীকে তার পোশাকের কারণে নিরাপত্তারক্ষীরা হয়রানি করে। ওই নারীকে ‘শালীন পোশাক' না পরার অভিযোগে দোকান থেকে বের করে দেওয়া হয়। গণপরিবহনেও নারীদের পোশাক নিয়ে হয়রানির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিছু সময় দেখা যায়, বাস বা ট্রেনের যাত্রীরা নারীদের পোশাক নিয়ে ‘মোরাল পুলিশিং' করে, আবার কখনো শারীরিক হয়রানির চেষ্টা করে। এই ধরনের ঘটনাগুলো প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভুক্তভোগী নারী তাদের অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের পোশাক নিয়ে বেশি মোরাল পুলিসিং করা হচ্ছে ফেসবুকে। বিনোদন জগতের তারকা বা কোন সেলিব্রিটি যখন ছবি বা ভিডিও পোস্ট করেন, সেখানে মন্তব্যের ঘরে বেশিরভাগ থাকে নেতিবাচক। পোশাক নিয়ে বিদ্রুপ, অপমানজনক মন্তব্য এবং মিম তৈরি করা হয় এসব পোস্ট নিয়ে।

বাংলাদেশের সমাজে নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনার মূলত দুটি দিক সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। একটি সমাজ থেকে দেওয়া অনুশাসন, আরেকটি ধর্মীয় চিন্তার জায়গা। শহর বা মফস্বল এলাকায় কিছু মানুষের কাছে নারীদের নৈতিকতার মাপকাঠি ‘শালীন' পোশাক। আর এই মানসিকতার পেছনের পুরুষতান্ত্রিক চাওয়ার একটা চিন্তা রয়েছে। আবার পোশাক নিয়ে এই বিতর্কের একটি বড় কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী নারীদের পোশাককে ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে যুক্ত করেন। এর ফলে নারী কী পরবে তা নিয়ে কঠোর ‘নৈতিক বিচার'-এর আবহ তৈরি হয়।

বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এসেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে ওইসব দেশের পোশাকি আচরণ বাঙালি নারীদের গ্রহণ করানোর চেষ্টা করা হয়। যদিও বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মরুভূমির এলাকার মানুষের পোশাক ও আচার-আচরণ ভিন্ন। ভূতাত্ত্বিক জায়গা ও অবস্থান থেকে এটি নির্ধারিত হয়ে থাকে।

সম্প্রতি ৯৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ তাজিকিস্তানে হিজাবকে ‘বিজাতীয় পোশাক' অভিহিত করে দেশটির সরকার এটি নিষিদ্ধ করেছে। এই আইন ভঙ্গকারীদের জন্য ৬৫ হাজার তাজিক সোমনি জরিমানার বিধান করা হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় যা ৫ লক্ষাধিক।

বাংলাদেশে নারীদের পোশাক নিয়ে আলোচনা প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এটি শুধু নারীদের পোশাকের স্বাধীনতাকেই প্রভাবিত করে না, বরং সমাজের লিঙ্গবৈষম্য ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়েও এক গভীর আলোকপাত করে। আবার এর বিপরীতে নারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান একটি অংশ রয়েছে, যারা নিজেদের পোশাকের স্বাধীনতা ও পছন্দের অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন।

তাহসিনা ইসলামছবি: privat

এমনিতে বাংলাদেশের নারীদের একটা অংশ পশ্চিমা বিশ্ব বা  পাশের দেশ ভারতের নারীদের পোশাকের ফ্যাশন বা স্টাইল অনুকরণ করেন৷ এটি বোঝা যায় ঈদের সময় পোশাকের বাজারের চাহিদা থেকে। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা ধর্মীয় বা প্রথাগত পোশাকের পরিবর্তে নিজেদের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করতে চায়। তাদের যুক্তি হলো, পোশাক কেবলমাত্র শারীরিক সুরক্ষা নয়, বরং এটি তাদের আত্মবিশ্বাস এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন।

আবার কিছুক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীদের পোশাকের ওপর সমালোচনা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক নারীই মাঝে মাঝে ফেসবুক লাইভ, পোস্ট বা ভিডিও বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন যে তারা তাদের পছন্দমতো পোশাক পরার জন্য হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। দেশের অনেকেই মনে করেন, নারীদের পোশাকের বিষয়টি ‘ইসলামি নীতি’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। তবে এই বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে৷ কিছু গোষ্ঠী নারীদের পোশাক নিয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে। ওয়াজ বা ধর্মীয় বয়ানের একটা অংশে নারীর চলাফেরা ও পোশাক নিয়ে আলোচনা থাকে। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

বাস্তবতা হলো, আজ পর্যন্ত নারীর জন্য এমন কোনো পোশাকের আবির্ভাব হয়নি, যা নারীকে মূল্যায়নের ঊর্ধ্বে রেখেছে, কিংবা তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কারণ, পোশাক কখনোই নারীকে নিরাপত্তা দেয় না, অতীতে দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না।

আমি ২০১৮ সালের একটি ঘটনা মনে করতে পারি। সেই বছর ঢাকার ওয়ারীতে একটি আট বছরের মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ধর্ষক বাচ্চাটির যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে নিয়েছিল তার সুবিধার্থে। এমন ভয়াবহতার বিপরীতে কখনো পোশাক নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারে এমনটি ভাবার অবকাশ থাকে না। নারী কী পরবেন সেটা সম্পূর্ণই তার অভিরুচির ওপর নির্ভর করে।

তবে নারীতদের পোশাকের বিষয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান করার পাশাপাশি, সমাজের মূল্যবোধ ও সংবেদনশীলতাকেও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

তাহসিনা ইসলাম তাহসিনা ইসলাম
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ