1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বাণিজ্যবাংলাদেশ

পোশাক শিল্প বাঁচানোর আশু উদ্যোগ প্রয়োজন

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক রুমা মোদক৷
রুমা মোদক
৪ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প যাদের জীবনের আলো দেখিয়েছে, তারা কি নিমজ্জিত হবে চরম অন্ধকারে?

ঢাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন পোশাক কর্মীরা৷ ফাইল ফটো ছবি: picture-alliance/NurPhoto/M. Hasan

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আর বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের জীবনমানের অভূতপূর্ব পরিবর্তনের গাথা যখন কেবল লিখতে শুরু করছি, ঠিক তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% ট্যারিফ আরোপের ঘোষণা এসেছে রপ্তানি শিল্পে। ধরা যায়, এর সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়বে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এবং সবচেয়ে ভয়াবহ মাশুল দেবে প্রান্তিকের নারীরা।

বাংলাদেশের প্রধানতম রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। আর তারপর ঔষধ শিল্প। তৈরি পোশাক থেকেই আসে রপ্তানি আয়ের ৮১ %। আর এই তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

এই মুখস্থ কথাগুলো কাগজে-কলমে লিখি কিংবা বলি। বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে। বাচ্চাদের জন্য এটা-সেটা কেনার পর ম্যানহাটনের এক ভ্যারাইটি শপ থেকে কিনলাম দুটো গেঞ্জি, বুকে 'আই লাভ নিউনিয়র্ক' মার্ক করা। একটা শহরের টোকেন। দেশে ফিরে বাচ্চাদের হাতে গেঞ্জি তুলে দিলে ওরাই দেখালো তাতে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সিল দেয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শপ থেকে এই গেঞ্জি দুটো কিনতে আমার লেগেছিল কুড়ি ডলার,তখনকার বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে আটশ টাকার সমমান। দেশ থেকে কিনলে হয়তো খুব বেশি হলে তিনশ টাকা করে কিনতে পারতাম গেঞ্জিগুলো। কিছু টাকা ‘ধরা খেয়েছি' বলে আমার মোটেই খারাপ লাগেনি। বরং এই ‘ধরা খাওয়া' আনন্দের, অহংকারের। আমি এনেছিলাম একটি বিশেষ শহরের স্মারক, যা এখানে টাকা দিয়েও মিলতো না। আর ভাবছিলাম, আমার ঘরে হাড়ি-পাতিল মাজার কথা ছিল যে মেয়েটির, সেই মেয়েটির বিকল্প শ্রমের মূল্য আমি দিয়ে এলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক শহরে। উপলব্ধিটা অসাধারণ, অতুলনীয়। কিন্তু এই উচ্চমূল্যের কতটা ভাগ সেই শ্রমিক মেয়েটি পায়?

আদতে এই যে অসাধারণ, অতুলনীয় উপলব্ধি, তার পেছনের গল্পটাও একটা দেশের খোলনলচে পালটে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। একটা দেশের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি'র ন্যারেটিভ ঝেড়ে ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গল্প। আর এই গল্পের চালিকাশক্তি দেশের প্রান্তিক নারীসমাজ। প্রায় অক্ষরজ্ঞানহীন,অদক্ষ ও অর্থনৈতিকভাবে হীন নারীশক্তি।

শুরুটা উইকিপিডিয়া, কিংবা বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে যতটা জানা যায়, সত্তর দশকের শেষ দিকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বেসরকারি উদ্যোগে। তখনো রপ্তানিমুখী শিল্প হিসাবে এর বিশাল সম্ভাবনা ছিল অন্তরালের বাস্তবতা, যে বাস্তবতা স্পর্শ করতে কেটে গেল আরো প্রায় এক দশক।

আশির দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বলতে গেলে ফুলে-ফেঁপে জাতীয় ও রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠলো। দেশের বাইরে তৈরি হলো এর বিরাট বাজার। উন্মুক্ত হলো সম্ভাবনা আর অর্জনের বিশাল দুয়ার। আর এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি নারী।

ছবি: privat

একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক যে নারী সমাজ, তাদের গরিষ্ঠ অংশ, যাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাটুকু ছিল না, তারা ছিল গৃহশ্রমিক। এই গৃ্হশ্রমিক আবার দুই রকম। নিজের স্বামী, কিংবা শশুরবাড়িতে উদয়াস্ত শ্রমের কোনো বিনিময় মূল্য ছিল না। আর এই অর্থনৈতিক অসচ্ছল নারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল শহরাঞ্চলের বাসা-বাড়ির গৃহকর্মী। মর্যাদা এবং পারিশ্রমিকের দিক থেকে যা ছিল লজ্জার। যে পরিচয় ছিল সামাজিকভাবে হেয় হয়ে থাকার ভয়ে লুকিয়ে রাখার মতো। বলতে গেলে দুইবেলা খাবারের বিনিময়ে এই নারীদের জীবন ‘দাসীবৃত্তির' উর্দ্ধে কিছু ছিল না।

গার্মেন্টস সেক্টরের উদ্ভব, দেশের বাইরে এর বিরাট বাজার এই প্রান্তিক নারীদের ভাগ্য খুলে দিলো। এক সকালে আমরা আবিষ্কার করলাম এক নতুন বাংলাদেশ। ঘরে বেকার সময় কাটানো প্রায় অশিক্ষিত, প্রশিক্ষণহীন,অদক্ষ, বেকার নারী সমাজ দলে দলে ঘর থেকে বের হয়ে এলো 'গার্মেন্টস শ্রমিক' হয়ে। প্রান্তিক নারীরা শহরমুখী হলো। তাদের শ্রমের বিনিময় মূল্য শুরু হলো চার অংকের টাকা দিয়ে। দেশের গার্মেন্টস শিল্প সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এই বিপুল সংখ্যক নারীদের শ্রমকে নির্ভর করে। দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী শিল্প হয়ে উঠলো গার্মেন্টস শিল্প। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসতে থাকলো গার্মেন্টস শিল্প থেকে। দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সোপান হয়ে উঠলো গার্মেন্টস শিল্প। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গার্মেন্টস শিল্প দেশের অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দখল করে আছে।

সামাজিকভাবে দেশের আভ্যন্তরীণ সমাজে এর প্রভাবও বিপুল ও বিশাল। প্রায় অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা পরিবারগুলোতে অর্থের জোগান বাড়ার সুযোগ তৈরি হওয়াতে ক্রমাগত কমতে থাকলো অভাব। উন্নতি ঘটলো জীবনমানের। এই প্রান্তিক নারীদের, যাদের এতকাল গোণায় ধরা হতোনা, তারা সচেতনে কিংবা অচেতনে হয়ে উঠলো দেশের মূল্যবান নারীশক্তি। স্ব স্ব সমাজে বাড়লো তাদের সামাজিক মর্যাদা। এতকাল অন্যের বাড়িতে ‘দাসীবৃত্তি' করা নারীরা এবার বুক ফুলিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘‘গার্মেন্টসে চাকরি করি।''

বলা বাহুল্য, এই যে নারীদের দেশের অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মতো একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যে ঘটনা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে দিয়েছে, তা নারীর জন্য বাস্তবিক অর্থে কতখানি মানবিক আর ন্যায়সঙ্গত হয়ে উঠেছে।এই প্রশ্নটি করার অবকাশ তৈরি হয় আইএলও নির্ধারিত শ্রম আইন ও শ্রমিক অধিকার বিবেচনায়। দৈনিক আটঘণ্টা কর্মঘণ্টা, মৌলিক প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক নির্ধারণ, সময়মতো পারিশ্রমিক প্রদান,নারীর কর্ম পরিবেশ ও বিপদ ঝুঁকির নিশ্চয়তা প্রদান,চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদান, চাকরি শেষ করার পর অবসরের সুযোগ-সুবিধা প্রদান ইত্যাদি একজন নারী শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা।

এর একটাও কি এই বিশাল সংখ্যক কর্মজীবী নারীরা পায়? কর্মক্ষেত্রে কথায় কথায় দুর্ব্যবহার, বেতন কাটা, চাকরিচ্যুতি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। অস্বাস্থ্যকর চাকরির পরিবেশ, অসহনীয় স্যানিটেশন ব্যবস্থা, যৌন হয়রানি, ছাঁটাই, সময়মতো বেতন পরিশোধ না করা এমন কোনো অন্যায্যতা নেই যা এই নারী শ্রমিকদের সাথে ঘটে না। জাতীয় আয়ের ৬৪% আসে যে গার্মেন্টস শিল্প থেকে, সেই গার্মেন্টস শিল্প দাঁড়িয়ে আছে যে বিশাল নারী জনগোষ্ঠীর উপর, সেই নারী গোষ্ঠী সবচেয়ে বঞ্চিত এবং শোষিত।

বিদেশি বায়ারদের পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেসব আবশ্যিক শর্ত থাকে, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি আর সুস্থ জীবনমান ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পে সবচেয়ে অবহেলিত থাকে এই বিষয় গুলি। গার্মেন্টস শিল্পে সবচেয়ে সস্তায় কেনা যায় বলে নারীর শ্রম

কেনা হয়। এই সস্তায় কেনা শ্রমের বিনিময়ে গার্মেন্টস মালিকদের লাভের হার বাড়ে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে মজুরি পায় তা দিয়ে মোটামুটি ভদ্রস্থভাবে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই ভাড়া পাওয়া যায় না। ফলে তারা অনেকজন মিলে অত্যন্ত মানবেতর পরিবেশে দিন গুজরান করার মতো ঠাঁই ভাড়া নেয়। যে মজুরি পায় তা দিয়ে তিনবেলা একজনেরই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অসম্ভব। পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা বাদই থাকুক। সাথে জুটে উর্দ্ধতনদের দুর্ব্যবহার, চাকরির নিরাপত্তাহীনতা। কোনো গার্মেন্ট কোনো নারী শ্রমিককে মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেয় বলে আমার জানা নেই। "যে দধিচীদের হাড় দিয়ে ঐ বজ্র শকট চলে..." এই দেশে এরা সবচেয়ে অবহেলিত।

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায়, ডিজিটাল মিডিয়ায় আমরা কয়েকমাস বেতন না পাওয়া শ্রমিকদের আহাজারি দেখেছি। খবরে জানা যায়, গত কয়েকমাসের বেতন বকেয়া। প্রতিবার ঈদ উৎসবের আগে বেতন- বোনাসের জন্য গার্মন্টেস শ্রমিকদের এই দাবি ফি বছর দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এই বছর তা একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে সংবেদনশীল মানুষের হৃদয় ছেঁদো করে দিয়েছে। ২৪-এর ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সব সেক্টরে লেগে যাওয়া অস্থিরতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে গার্মেন্টস সেক্টরে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কমে গেছে বিদেশের বাজার। আর এর সুযোগ নিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা সবার আগে বঞ্চনার কোপটা দিয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকcর উপর। তারা বেতন-ভাতা, ন্যায্য পাওনার দাবিতে নেমে এসেছে রাস্তায়,পুলিশের হাতে লাঠিপেটা হয়েছে। জলকামানে বিপর্যস্ত হয়েছে,জাতীয় এবং বিশ্ব মিডিয়ায় ছবি হয়েছে, খবর হয়েছে, কিন্তু বেতন জোটেনি।

এই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এসেছে। আমরা উপচে পড়া ভীড় দেখেছি আড়ংয়ের মতো অভিজাত ব্র্যান্ডের দোকানে, অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকদের হয়তো ঈদের সেমাই কেনার টাকা জোটেনি।

মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এবার এই সংকটের আগুনে ঘি ঢেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ট্যারিফের হার। এই উচ্চ ট্যারিফের বিরাট প্রভাব পড়বে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে। যদি শিল্পটি স্থবির হয়, সংকুচিত হয়, কিংবা কোনো আপস করে বাজারের আধিপত্য ধরে রাখতে চায়, তবে বেশি মাশুল দেবে এই নারী শ্রমিকরা।

বেগম রোকেয়া একটি সমাজকে তুলনা করেছিলেন দুই চাকার সাইকেলের সাথে। পুরুষ তার একটি চাকা হলে নারী অন্যটি।একটি চাকা দিয়ে যেমন সাইকেল এগুতে পারে না, সমাজও তেমন। এক চাকা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না।

এদেশের বৃহত্তর নারী সমাজ, যাদের শিক্ষা নেই, কিংবা শিক্ষার সুযোগ নেই, প্রশিক্ষণ, নেই,দক্ষতা নেই। সমাজে যারা সম্পদ নয় গলগ্রহ হয়ে বেঁচে ছিল গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতির সাথে একসাথে গাঁথা হয়েছিল তাদের সম্পদ হয়ে উঠার সমান্তরাল গাথা। নানা বঞ্চনা,শোষণ, অন্যায়ের পরও মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার একটা বড় প্রবেশ তোরণ ছিল এই গার্মেন্টস শিল্প।

রাষ্ট্রযন্ত্র, সুবিধাভোগী স্টকহোল্ডার,দেশপ্রেমিক,অর্থনীতিবিদ সবার উচিত খুব দ্রুত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় খোঁজা। নইলে জাতীয় আয়,রপ্তানি আয় তো কমবেই, বিশাল দায় হয়ে উঠবে এদেশের প্রান্তিক নারী সমাজ। বাড়বে দারিদ্র্য আর সাথে বাড়বে আনুষঙ্গিক সামাজিক অস্থিরতা।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ