করোনা মহামারিতে তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন সাড়ে তিন লাখেরও বেশি শ্রমিক৷ জীবন বদলের স্বপ্ন নিয়ে যারা শহরমুখী হয়েছিলেন, তাদের জীবন বাঁচানোই এখন কঠিন৷
বিজ্ঞাপন
২০১২ সালের কথা৷ আমি তখন ঢাকায় থাকি৷ আমাদের বাড়ির ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজ করতেন সালমা৷ বয়স ২৫ থেকে ৩০- এর মধ্যে৷ বাড়ির কাছে টিনের ঘরে থাকতেন৷ স্বামী রিকশা চালান আর সালমা বাড়ি বাড়ি কাজ করেন৷ মাসে চার হাজার টাকা দেয়া হয়৷ প্রায়ই ওর কাছে শুনি স্বামী মারধোর করে৷ বলে এই স্বামীর ঘর করবে না৷ ভালো চাকরি পেলে ছেড়ে দেবে৷ ভালো চাকরি কোনটা জিজ্ঞেস করলে বলে গার্মেন্টেসে চাকরি করবে৷ এই সালমা একদিন সত্যি সত্যি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়ে গেল৷ কাজ ছেড়ে যেদিন পাওনা টাকা নিতে এলো, ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখেছিলাম আত্মতৃপ্তির হাসি৷ বলেছিল, ‘‘আপা, এখন থেকে আর বলতে হবে না অন্যের বাসায় কাজ করি৷ এখন দেশে গেলে বলবো গার্মেন্টসে চাকরি করি৷ লোকজন সম্মান দিয়ে কথা বলবে৷’’
কেমন আছেন পোশাক শ্রমিকরা
করোনার কারণে গত বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের আয়ে ধস নামে৷ বিপর্যয় নেমে আসে শ্রমিকদের জীবনেও৷ তবে সেই ধাক্কা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চাকরির খোঁজে
কে এ ডাব্লিউ গার্মেন্টসে প্রধান ফটকের বাইরে ফারজানা আক্তার দাঁড়িয়ে কথা বলছেন নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে৷ করোনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের খরচ সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছেন তিনি চাকরির খোঁজে৷ কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে পরে আসতে বলে বিদায় দিলেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেতন তুলতে পারেননি
আশিকুর রহমান পড়াশোনার পাশাপাশি রাজধানীর কচুক্ষেতের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেন৷ লকডাউনের সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট দিনে ৬০ ভাগ বেতন দেওয়া হয়েছিল৷ সেদিন উপস্থিত হতে পারেননি তিনি৷ পরে আর বেতনই পাননি৷ ‘‘নিজের ঘাম ঝরানো পারিশ্রমিক কেন দেওয়া হবে না’’, এমন প্রশ্ন তার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ওভারটাইম কমপক্ষে ৪০ ঘন্টা
মিরপুর ১৩ নম্বরের জকি গার্মেন্টস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ জানান, প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানাতেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পাশাপাশি অতিরিক্ত সময় কাজের ব্যবস্থা আছে৷ এক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই লাভবান হন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দাবি আদায়ে আন্দোলন
এটি ২০২০ সালের জুনের ছবি৷ মিরপুর ১২-র ‘জয়েনটেক্স নিট ওয়্যারস লিমিটেড’ এ করোনাকালীন সময়ে প্রায় ৫০০ শ্রমিককে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং বেতন-বকেয়া আদায়ের দাবিতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা সেসময় আন্দোলন করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চাকরি গেছে পরিচিতদের
ডায়নামিক্স সোয়েটার ফ্যাক্টরি লিমিটেডে সুইং অপারেটর পদে কাজ করা মো. জসিম উদ্দিন জানান, লকডাউন চলাকালে তিনি নিজে চাকরিচ্যুত না হলেও পরিচিত বেশ কয়েকজনের চাকরি গেছে৷ তবে তার মতে কাজ জানা থাকলে এ শিল্পে বেশিদিন বেকার থাকতে হয় না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জমানো টাকা খরচ
লকডাউনের সময় পোশাকশ্রমিক রুবিনা আক্তার এবং তার স্বামী দুই মাস বেকার ছিলেন৷ প্রণোদনার ৬০% বেতন পেলেও তা দিয়ে ঢাকার ব্যয়বহুল জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় সমিতিতে জমানো টাকা খরচ করতে হয়েছে তাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবারকে পাঠিয়েছেন গ্রামে
একাধিক পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার আগে পরিবারে আয়ের একাধিক সদস্য থাকলেও এখন আর তা নেই৷ পারিবারিক খরচ সামলাতে এখন যিনি কাজ করছেন, শুধু তিনি ছাড়া বাকি সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঋণ শোধের সময় বৃদ্ধি
করোনার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য গত বছর উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছিল সরকার৷ সেটি পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়েছে৷ অপরিশোধিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে আগামী মার্চ থেকে ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড পাবেন উদ্যোক্তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দুই মাস বেতন পাননি
এসনেহার আক্তার কাজ করেন মিরপুরের ভাই-বন্ধু ডিজাইন হাউজ নামের এক পোশাক কারখানাতে৷ তিনি জানান, লকডাউনের দুই মাস তাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হয়নি, বরং বেতন চাইলে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখানো হয়েছে৷ প্রতিবেশীদের সহযোগিতা না পেলে না খেয়ে মরতে হতো বলেও জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
9 ছবি1 | 9
এর পরের বছরই দেশ ছেড়েছি৷ জানি না সালমা এখন কেমন আছে৷ করোনায় সংবাদপত্রে যতবার পোশাকশিল্প কারখানার খারাপ খবরগুলো চোখে পড়ছিল, ততবার মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল সালমার সেই আত্মতৃপ্তির হাসিভরা মুখটা৷ এমন কত সালমা ঢাকায় কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে আসেন৷ এখন ঢাকায়, এমনকি দেশের বাড়িতে গেলেও শুনতে পাওয়া যায়- ‘‘আজকাল কাজের লোকের অভাব, কারণ, সবাই গার্মেন্টসে চাকরি করে৷’’ এটা একটা দেশের উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি৷ কিন্তু সেই উন্নয়ন হঠাৎ বাধাগ্রস্ত হলো করোনার কারণে৷ এই মহামারি ধনীদের সম্পদ আরো বাড়ালো আর গরিবদের আরো নিঃস্ব করে দিলো৷
বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছর তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক৷ নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে৷ এমনকি অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে৷
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’র (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে৷
জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ কর্মীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জনের মতো চাকরি হারিয়েছেন, যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ৷
সিপিডি জানিয়েছে, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি৷ মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনে বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে৷
সিপিডি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আগে ছাঁটাইকৃত কর্মী৷ নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের আরো কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে৷ শ্রমিকরা চাকরি পেলেও আগের চাকরি চলে যাওয়ার কারণে তারা উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হয়েছে৷
সমীক্ষার এই চিত্র থেকেই স্পষ্ট, তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসছে৷ করোনাকাল যদি আরো দীর্ঘ হয়, তাহলে হয়ত আবার তাদের পুরোনো জীবনে ফিরে যেতে হবে৷ কেউ হয়ত নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন, অনেকে হয়ত অন্য পেশা বেছে নেবেন৷ কিন্তু সালমাদের মতো যারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের স্বপ্ন কি অধরাই থাকবে?
গতবছর ১ জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...
চাকরি হারিয়ে বিপর্যস্ত পোশাক শ্রমিকদের কথা
করোনা মহামারিতে অর্ডার কমে যাওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে ছাঁটাই করা হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের৷ ফলে তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত৷ ছবিঘরে থাকছে এরকম কয়েকজন পোশাক শ্রমিকের কথা৷
ছবি: DW/S. Hossain
অর্ধেক বেতন দিয়ে বিদায়
৩৫ বছর বয়সি তাসলিমা আক্তার ঢাকার একটি কারখানায় সাত বছর কাজ করেছেন ‘ফিনিশিং কোয়ালিটি’ হিসেবে৷ তার মাসিক বেতন ছিল ৭,৭৪৫ টাকা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘মার্চ পর্যন্ত এই বেতনে কাজ করার পর এপ্রিল মাসে আমাকে অর্ধেক বেতন দিয়ে চাকরিচ্যূত করা হয়৷ এখন অন্য কোনো চাকরি পাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷’’ তাসলিমার দশজনের সংসার এই বেতনের উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: DW/S. Hossain
মার্চেই শেষ চাকরি
১৭ বছর বয়সি সোনিয়া পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ফিনিশিং হেলপার হিসেবে৷ মাসে বেতন পেতেন ৫,৩০০ টাকা৷ তিনি বলেন, ‘‘মার্চ পর্যন্ত কাজ করার পর চাকরি হারিয়েছি৷ করোনার জন্য এখন অন্য কোনো চাকরি পাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷’’
ছবি: DW/S. Hossain
করোনার কারণে মিলছে না চাকরি
৪৫ বছর বয়সি খোদেজা ফিনিশিং হেলপার হিসেবে ৯ বছর কাজ করেছেন৷ প্রতি মাসে ৭,৬০০ টাকা মাসিক বেতনে তিনি কাজ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মার্চ মাস থেকে বেকার৷ করোনার কারণে এখন অন্য কোথাও চাকুরিও পাওয়া যাচ্ছে না৷’’
ছবি: DW/S. Hossain
শ্রমিক ইউনিয়নের সহায়তা
১৯ বছর বয়সি সীমা আক্তার কাজ করেছেন হেলপার হিসেবে৷ প্রতি মাসে ৮,৩০০ টাকা বেতন ছিল তার৷ করোনার কারণে হঠাৎই চাকুরিচ্যুত করা হয় তাকে৷ পরবর্তীতে অবশ্য শ্রমিক ইউনিয়নের সহায়তায় চাকুরি ফেরতও পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: DW/S. Hossain
রিয়াজুলের বেকার জীবন
পোশাক শ্রমিক রিয়াজুল ইসলামের বয়স ৩৩ বছর৷ দুই বছর বেশি সময় কাজ করেছেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়৷ বর্তমানে তিনি চাকরিচ্যূত, করোনার কারণে তিনি কোথাও চাকরি পাচ্ছেন না৷
ছবি: DW/S. Hossain
এক মাসের বেতন দিয়ে বিদায়
মশিউর রহমানের বয়স ২৪ বছর৷ ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় জ্যাকার অপারেটর হিসেবে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় চাকুরি করেছেন৷ মাসে বেতন পেতেন ১৩,৫০০ টাকা৷ একমাসের বেসিক দিয়ে মে মাসে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়৷
ছবি: DW/S. Hossain
করোনায় মেলে না চাকরি
স্ত্রীসহ ঢাকায় থাকেন ৩১ বছর বয়সি পোশাক শ্রমিক এরশাদুল৷ একটি পোশাক কারখানায় তার মাসিক বেতন ছিল ১০,১০০ টাকা৷ বর্তমানে তিনি চাকরিচ্যূত, করোনার কারণে তিনি কোথাও চাকরি পাচ্ছেন না৷
ছবি: DW/S. Hossain
বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মবিরতি
৪ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কর্মবিরতি পালন করছেন শ্রমিকরা৷ তারা দাবি করেছেন, মালিকপক্ষ তাদের বেতন না দিয়ে চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে চায়৷ তবে বকেয়া বেতন ছাড়া চাকরি থেকে বিদায় নিতে রাজি নন কেউ৷