গতবছর করোনার শুরুতে পাকিস্তানের এক পোশাক কারখানায় কাজ করা আব্দুল ওয়াজিদের চাকরি চলে গিয়েছিল৷ তিনমাস পর আগের চেয়ে কম টাকায় বেশি ঘণ্টা কাজ করতে রাজি হয়ে আবারও চাকরিতে যোগ দেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
‘‘কয়েকমাস কোনো আয় না থাকায় আমি চাকরি পেতে মরিয়া ছিলাম৷ তাই তারা যা বলেছে, তাতেই রাজি হয়ে গেছি৷ এখন বেঁচে থাকতে আমাকে ঋণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে,’’ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে সম্প্রতি জানান ওয়াজিদ৷ তার নতুন চাকরির চুক্তি বলছে, তিনি যদি তার আগের পাওনা একমাসের বেতন না পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করেন তাহলে চাকরি চলে যেতে পারে৷
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুটি সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, করোনার ক্ষতি কাটাতে পশ্চিমা বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড পোশাক প্রস্তুতকারকদের উপর চাপ দিচ্ছে৷ আর সেই চাপ প্রস্তুতকারকদের মাধ্যমে গিয়ে পড়ছে শ্রমিকদের উপর৷
এছাড়া করোনার কারণে চাকরি হারানো বিশ্বের কয়েক লাখ পোশাক শ্রমিকের কয়েক মাসের বেতন, এবং চাকরিচ্যুত বা চাকরি ছাড়ার কারণে যে টাকা পাওয়ার কথা, তা এখনও বাকি আছে৷
কেমন আছেন পোশাক শ্রমিকরা
করোনার কারণে গত বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের আয়ে ধস নামে৷ বিপর্যয় নেমে আসে শ্রমিকদের জীবনেও৷ তবে সেই ধাক্কা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চাকরির খোঁজে
কে এ ডাব্লিউ গার্মেন্টসে প্রধান ফটকের বাইরে ফারজানা আক্তার দাঁড়িয়ে কথা বলছেন নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে৷ করোনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের খরচ সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছেন তিনি চাকরির খোঁজে৷ কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে পরে আসতে বলে বিদায় দিলেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেতন তুলতে পারেননি
আশিকুর রহমান পড়াশোনার পাশাপাশি রাজধানীর কচুক্ষেতের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেন৷ লকডাউনের সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট দিনে ৬০ ভাগ বেতন দেওয়া হয়েছিল৷ সেদিন উপস্থিত হতে পারেননি তিনি৷ পরে আর বেতনই পাননি৷ ‘‘নিজের ঘাম ঝরানো পারিশ্রমিক কেন দেওয়া হবে না’’, এমন প্রশ্ন তার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ওভারটাইম কমপক্ষে ৪০ ঘন্টা
মিরপুর ১৩ নম্বরের জকি গার্মেন্টস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ জানান, প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানাতেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পাশাপাশি অতিরিক্ত সময় কাজের ব্যবস্থা আছে৷ এক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই লাভবান হন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দাবি আদায়ে আন্দোলন
এটি ২০২০ সালের জুনের ছবি৷ মিরপুর ১২-র ‘জয়েনটেক্স নিট ওয়্যারস লিমিটেড’ এ করোনাকালীন সময়ে প্রায় ৫০০ শ্রমিককে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং বেতন-বকেয়া আদায়ের দাবিতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা সেসময় আন্দোলন করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চাকরি গেছে পরিচিতদের
ডায়নামিক্স সোয়েটার ফ্যাক্টরি লিমিটেডে সুইং অপারেটর পদে কাজ করা মো. জসিম উদ্দিন জানান, লকডাউন চলাকালে তিনি নিজে চাকরিচ্যুত না হলেও পরিচিত বেশ কয়েকজনের চাকরি গেছে৷ তবে তার মতে কাজ জানা থাকলে এ শিল্পে বেশিদিন বেকার থাকতে হয় না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জমানো টাকা খরচ
লকডাউনের সময় পোশাকশ্রমিক রুবিনা আক্তার এবং তার স্বামী দুই মাস বেকার ছিলেন৷ প্রণোদনার ৬০% বেতন পেলেও তা দিয়ে ঢাকার ব্যয়বহুল জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় সমিতিতে জমানো টাকা খরচ করতে হয়েছে তাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবারকে পাঠিয়েছেন গ্রামে
একাধিক পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার আগে পরিবারে আয়ের একাধিক সদস্য থাকলেও এখন আর তা নেই৷ পারিবারিক খরচ সামলাতে এখন যিনি কাজ করছেন, শুধু তিনি ছাড়া বাকি সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঋণ শোধের সময় বৃদ্ধি
করোনার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য গত বছর উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছিল সরকার৷ সেটি পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়েছে৷ অপরিশোধিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে আগামী মার্চ থেকে ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড পাবেন উদ্যোক্তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দুই মাস বেতন পাননি
এসনেহার আক্তার কাজ করেন মিরপুরের ভাই-বন্ধু ডিজাইন হাউজ নামের এক পোশাক কারখানাতে৷ তিনি জানান, লকডাউনের দুই মাস তাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হয়নি, বরং বেতন চাইলে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখানো হয়েছে৷ প্রতিবেশীদের সহযোগিতা না পেলে না খেয়ে মরতে হতো বলেও জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
9 ছবি1 | 9
পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন ‘এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স’ এএফডাব্লিউএর ইন্টারন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর অনন্যা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বেতন চুরি বিশ্বের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর একটি স্বাভাবিক ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত হয়েছে, এবং মহামারির কারণে সেটা আরও বেড়েছে৷’’
ছয়টি দেশের ১৮৯টি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ‘অর্থ চুরি’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এএফডাব্লিউএ৷ এতে বলা হয় বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের ‘ব্যবসার ঝুঁকি’ পোশাক প্রস্তুতকারকদের উপর স্থানান্তর করছে৷ প্রতিবেদন বলছে, মহামারির সময়ে অনেক ব্র্যান্ড তাদের অর্ডার বাতিল করেছে৷ এর মধ্যে এমন সব অর্ডার ছিল যেগুলো তৈরির জন্য কাঁচামাল কেনা হয়ে গিয়েছিল৷ এমনকি পোশাক তৈরি শেষে ব্র্যান্ডগুলোর কাছে পাঠানো হয়ে গেছে এমন সব পোশাকের জন্যও অর্থ দিতে রাজি হয়নি অনেক ব্র্যান্ড৷ ফলে প্রস্তুতকারকরা টাকার অভাবে শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে পারেনি৷
এদিকে, ব্রিটেনের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম’ করোনার পর চাকরি পরিবর্তন করা ইথিওপিয়া, হন্ডুরাস, ভারত ও মিয়ানমারের প্রায় এক হাজার পোশাক শ্রমিকের উপর একটি গবেষণা করেছে৷ এতে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ শ্রমিককে লিখিত বা মৌখক কোনো চুক্তিপত্র দেয়া হয়নি৷ আর ১৯ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছে, আগের চেয়ে কম বেতনে তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন৷