পোশাক শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় ইউরোপের চাপ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১০২০১০-এর ফেব্রুয়ারি মাস৷ স্থান, গাজীপুরের সোয়েটার কারখানা ‘গরিব অ্যান্ড গরিব'৷ হঠাৎ আগুন৷ ঝরে গেল ২১টি প্রাণ৷ টিভি, পত্রপত্রিকা সব জায়গায় হৈচৈ৷ তদন্ত কমিটি গঠন৷ কারখানায় অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখার জন্য মালিকদের ওপর সরকারের আবারও চাপ৷ তারপর? তারপর একসময় সব স্বাভাবিক৷ কেউ চিন্তা করলনা ঐ ২১টি প্রাণের কথা৷ তাদের পরিবারের কথা৷
কিন্তু বাংলাদেশে কেউ চিন্তা না করলে কী হবে৷ আছে ‘ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন' বা সিসিসি৷ ইউরোপের সংস্থা এটি৷ পোশাক শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করে তারা৷ আগামী সপ্তাহে জার্মানির বার্লিনে একটি আলোচনা ও বিক্ষোভের আয়োজন করেছে সিসিসি৷ উদ্দেশ্য - ‘গরিব অ্যান্ড গরিব' কোম্পানির কারখানার আগুনে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা৷
কিন্তু আগুন লাগল বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় আর ক্ষতিপূরণের জন্য বিক্ষোভ জার্মানিতে! ঘটনা হলো, ‘গরিব অ্যান্ড গরিব' যে সোয়েটার তৈরি করে সেটা কেনে জার্মানির বিখ্যাত এইচঅ্যান্ডএম কোম্পানি৷ তাই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাদেরও, এমনটাই দাবি সিসিসি'র৷ কারণ এইচঅ্যান্ডএম-এর কাছে কম দামে সোয়েটার বিক্রির জন্য গরিব এন্ড গরিব শ্রমিকের সুযোগ সুবিধার দিকে নজর দেয়নি৷ তাদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করেনি৷ তাই পরোক্ষভাবে দায়ী এইচঅ্যান্ডএম'ও৷
এবার সিসিসি সম্পর্কে কিছু তথ্য৷ প্রতিষ্ঠিত ১৯৮৯ সালে, নেদারল্যান্ডসে৷ বর্তমানে কাজ করছে ইউরোপের ১৪টি দেশে৷ আর সারা বিশ্বে আড়াইশো'রও বেশি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে রয়েছে তাদের সম্পর্ক৷
এই ক্যাম্পেইনের সঙ্গে জড়িত একজন ইরমগার্ড বুজেমান৷ তিনি বললেন, শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ ও সেটা যেন জীবিকার জন্য পর্যাপ্ত হয় তা নিশ্চিত করা, কাজের পরিবেশ নিরাপদ ও উন্নত করা এবং একটা নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা ঠিক করা৷ এসব বিষয় নিশ্চিত করতে সিসিসি রপ্তানিকারকদের জন্য একটি ‘কোডস অব কন্ডাক্ট' তৈরি করেছে৷ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সঙ্গে মিল রেখে এটা তৈরি হয়েছে৷ রপ্তানিকারকরা যেন তাদের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই কোডস অব কন্ডাক্ট মেনে চলেন সেটা নিশ্চিত করতে কাজ করে সিসিসি৷
শুধু রপ্তানিকারকই নয়, আমদানিকারকদেরও সচেতন করতে কাজ করে সিসিসি৷ বুজেমান বলেন, বাংলাদেশের যেসব কারখানা কোডস অব কন্ডাক্ট মানছেনা, তাদেরকে যেন কোন কাজের অর্ডার দেয়া না হয়, সে ব্যাপারে ইউরোপীয় আমদানিকারকদের অনুরোধ করেছেন তারা৷
তিনি বলেন, সিসিসি বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকের অধিকার নিয়ে চিন্তিত৷ কারণ তাঁরা কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরণের বৈষম্যের শিকার হন৷ অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের পরেও তাদের কাজ করতে হয়৷ এবং এজন্য তারা আলাদা কোন টাকা পাননা৷ অনেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাননা, বা পেলেও ছুটিতে থাকাকালীন তারা কোন বেতন পাননা৷ কারণ এধরণের কোন নিয়ম নেই কারখানাগুলোতে৷
এসব বিষয় নিশ্চিত করতে তিনি চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় সবাইকে নিয়োগপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান৷ আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মেনে এসব নিয়োগপত্র তৈরির উপরও জোর দেন তিনি৷
শুধু কোম্পানিই নয়, ক্রেতাদেরও সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছে সিসিসি৷ বিজ্ঞাপন দেয়া, আলোচনা সভার আয়োজন, বিক্ষোভ, লিফলেট বিতরণ এসবের মাধ্যমে ক্রেতাদের সচেতন করার কাজ করে থাকে সিসিসি৷
কিন্তু এসব কাজ করে কি কোন সফলতা পাওয়া গেছে? উত্তরে বুজেমান বললেন, ‘‘হ্যাঁ, অনেক দেশেই শ্রম ও মানবাধিকার আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে মামলা করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আবার আন্দোলন করতে গিয়ে শ্রমিকরা জেলে গেলে তাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ অনেক কারখানার মালিক সিসিসি'র অনুরোধে সাড়া দিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিয়েছেন৷''
এরপর একটি উদাহরণ দিলেন তিনি৷ বাংলাদেশে ঈদের ঠিক আগে আগে মুক্তি পেয়েছে তিন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী৷ যারা পোশাক কারখানায় বিক্ষোভে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে একমাস ধরে কারাগারে ছিলেন৷ কিন্তু সিসিসির বিবেচনায় তারা ছিলেন নিরপরাধ৷ তাই তাদের ছাড়াবার ব্যাপারে চেষ্টা শুরু করে সিসিসি৷ অবশেষে সফল হয় তারা৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ